
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বাঙালীর জাতীয় জীবনে আগস্টের ভয়াবহতা, নৃশংসতা ও শোককে কোন শব্দ বা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। সে যেন অতল গভীর অনুভূতি ও বেদনা! যখন বুঝতে শিখেছি, তখন থেকে মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন আমাকে অস্থির করে তোলে প্রতিনিয়ত। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় ও পরবর্তীতে যারা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকে তাঁকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, যারা রাজনৈতিক দায়িত্বে থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেননি, যারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিরোধ গড়ে তোলেননি, তাদের কি কোন দায় নেই? তারা কীভাবে আজও সমাজ ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ভূমিকায় থাকে? তাদের সুদৃঢ় অবস্থান যৌক্তিকভাবে আশঙ্কাজনক নয় কি? মানুষ শেখ মুজিবের খুনের বিচার হয়েছে, কিন্তু জাতির পিতাকে হত্যার বিচার হয়েছে কি? জাতির পিতাকে হত্যার বিচার-পরিসর কেমন হওয়া উচিত? যারা বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেননি বা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ করেননি তারা কোন সময়ে কি বঙ্গবন্ধুকন্যা বা বাংলাদেশের কোন প্রয়োজনে ও সঙ্কটে সাহসী ভূমিকা নেবেন?
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বাবা-মা-ভাইসহ পরিবার পরিজনকে হারিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নিঃস্ব হয়েছিলেন, নিভে গিয়েছিলেন। তবুও হৃদয়ের কোন এক গভীর কোনে হয়ত একটি প্রদীপ নিভু নিভু আলোয় জ্বলছিল। সে আলো মুক্তির, সে আলো ঘুরে দাঁড়ানোর, সে আলো প্রতিশোধের। বাঙালীর মুক্তি এবং ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ফিরে এলেন স্বদেশে। তিনি ফিরে এলেন সব হারানোর প্রতিশোধ নিতে। ফিরে এসে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিলেন। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নেতাকর্মীরা ফিরে পেল প্রাণস্পন্দন। তবে দলের ভেতরে গড়ে উঠল পীর সংস্কৃতি। তারা আধ্যাত্মিক নয়, রাজনৈতিক পীর।
তারা বঙ্গবন্ধুকন্যার বাইরে রাজনীতির একটি বলয় গড়ে তুলল। তাদের যোগাযোগ ছিল প্রতিকূল শক্তির সঙ্গে। তারা প্রতিমূহূর্তে জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে লাগল। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা দলের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের সব প্রতিকূলতাকে পরাভূত করলেন অমিত সাহস, সততা ও জনসমর্থন দিয়ে। সাধারণ মানুষের ভালবাসা তাঁকে স্বপ্ন ও শক্তি দিয়েছে। তিনি প্রাণপণ লড়েছেন দল ও দেশের জন্য, মানুষের জন্য। আজ তিনি শিকড় থেকে শিখরে আরোহণকারী জনগণমন নেত্রী। তবে সেই পীর সংস্কৃতির সিলসিলা এখনও আছে দলের ভেতরে। মানুষের শরীরে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শ্বেত-রক্তকণিকা দেহরক্ষার অংশ হিসেবে ক্ষণপদ সৃষ্টি করে দেশে অনুপ্রবেশকারী জীবাণুকে (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস প্রভৃতি) প্রতিহত করে এবং দেহকে সুস্থ রাখে তাকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় ফ্যাগোসাইটসিস।
একটি দলের ফ্যাগোসাইটসিস হচ্ছে নিবেদিত ও বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ। যারা দলকে সুস্থ রাখে, সবল রাখে, সক্রিয় রাখে। অথচ পীর সংস্কৃতির সিলসিলার কারণে আজও নিবেদিত কর্মীরা অবহেলিত, উপেক্ষিত ও নিষ্পেষিত। নিবেদিত নেতাকর্মীদের নিষ্পেষণ মূলত জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতকে দুর্বল করার নামান্তর। রাজনীতির একমুখিতা দলের মৌলিকত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করে। অথচ দলের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পীররা দলকে বহুমুখী করে ফেলছে। এটি অশনিসঙ্কেত! যারা কারও মুখাপেক্ষী নয়, যারা নিজ যোগ্যতায় রাজনীতির মাঠে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক কর্মী হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য দল ও নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার কাজটা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করে, তারা এই নব্যপীরদের প্রধান শিকার। যারা একান্ত নেত্রীর প্রতি অনুগত তাদের খেয়ে ফেলার যে সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া চলছে, তাতে কী নয়া আগস্টের গন্ধ পাওয়া যায় না?
দূষিত পানি বা বায়ু যেমন প্রাণ-প্রকৃতির জন্য ক্ষতিকর, দূষিত প্রজন্মও তেমন দেশ ও দশের জন্য ক্ষতিকর। পানি বা বায়ুর মতো প্রজন্মেরও পরিশোধন প্রয়োজন। তবে অতি দূষিত কোন কিছুই পরিশোধ্য নয়। সেক্ষেত্রে অপসারণ প্রয়োজন হয়। যারা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ তথা বাঙালী জাতিকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে কাপুরুষের মতো নিশ্চুপ থেকেছে, তারা আজও দেশের যেকোন অন্যায়, অসঙ্গতির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থাকে। ভূমিদস্যু, বাজারদস্যু, পরিবহন-মাফিয়াসহ সকল অরাজকতাকারীদের বিরুদ্ধে তারা কখনও শক্ত অবস্থান নেয় না, প্রতিবাদ করে না। তারা শুধু সুযোগ ও সুবিধার মুখাপেক্ষী। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, তবে তাদের বিশ্বাস করা ভয়ঙ্কর।
আগস্ট মাস পৃৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালী জাতির জন্য সবচেয়ে অশনি-মাস। ১৫ আগস্ট, ১৭ আগস্ট, ২১ আগস্ট তারিখগুলো কোন স্বাভাবিক তারিখ নয়। এগুলো বাংলাদেশকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চক্রান্ত ও প্রচেষ্টার তারিখ। এ মাসে অপশক্তিরা জেগে ওঠে, সংগঠিত হয়, সম্প্রসারিত হয় নয়া আগস্টের পরিকল্পনায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রীকে সবসময় একটি ঘাতক-বুলেট তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নেত্রীর নিজের মুখের কথায় আমরা বুঝতে পারি তাঁর জীবন কতটা ঝুঁকিতে আছে প্রতিটাক্ষণ। তিনি এও বলেন যে, দলের ভেতরে তাঁকে ছাড়া সবাইকে কেনা সম্ভব। এ কথাগুলো কথার কথা নয়। কথাগুলো অনেক ভারী এবং অর্থবহ। তাঁকে রক্ষা করা আমাদের জাতির দায় ও কর্তব্য।
বাংলাদেশের জন্য তাঁর বেঁচে থাকাটা বড় প্রয়োজন, যিনি লড়ছেন বিষভধৎব ভড়ৎ ধষষ-এর জন্য, যিনি লড়ছেন একটি মঙ্গলরাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য। আগস্ট আমাদের শোকের মাস যে শোক থেকে পুনর্জন্ম হয়েছে শক্তির, আর শক্তি থেকে জাগরণ, জাগরণ থেকে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের শপথ। সুতরাং এ মাসে আমাদের সজাগ থাকতে হবে, সচেতন হতে হবে, সোচ্চার হতে হবে সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে এবং সকল মঙ্গলের পক্ষে। আর যেন রচিত না হয় কোন নয়া আগস্ট। আর যেন কোন কালো ভোর বাঙালীর সম্ভাবনার সূর্যকে গ্রাস করে ফেলতে না পারে। আর যেন আমাদের শোক ও গ্লানির অতলে হারিয়ে যেতে না হয়। এই প্রত্যাশা করি।
লেখক : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির সদস্য