ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অনুপ্রেরণার উৎস বঙ্গমাতা

ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ৭ আগস্ট ২০২২

অনুপ্রেরণার উৎস বঙ্গমাতা

.

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন ছায়াসঙ্গীতিনি বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে বঙ্গবন্ধুকে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন ও প্রেরণা দিয়েছেনলোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে রেখে গেছেন অনন্য ভূমিকাএকই পরিবারে বড় হয়ে ওঠা দুজনের একসঙ্গে পথচলা জীবনের শুরু থেকেইবঙ্গমাতা একেবারে কৈশোর বয়সে শেখ মুজিবের সহধর্মিণী হয়েছিলেনবেশি লেখাপড়া না করা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের যোগ্য সহধর্মিণী এবং সহযোদ্ধাকলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনা করা এবং তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বঙ্গমাতার ছিল সহযোগিতা ও সমর্থন

তিনি শুধু স্বামী, সন্তান, সংসার ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনই করেননিতিনি একদিকে যেমন সাধারণ একজন বাঙালী নারীর মতো স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে সর্বক্ষণের সহযোগী ও অনুপ্রেরণাদাত্রী হয়ে নিভৃতে কাজ করে গেছেনজীবনের শুরু থেকেই যে সংসারের মাঝে নিজের জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছিলেন, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সে সংসারের হাল ধরে রেখেছিলেন দক্ষ নাবিকের মতো

বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন বঙ্গমাতা ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ছাত্র নেতাদের পরম নির্ভরতার শেষ আশ্রয়স্থলবঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনাও নেতাকর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেনআন্দোলন ও সংগ্রামে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতেনতিনি দলকে সংগঠিত করা এবং সঠিক সময়ে সঠিক এবং কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণে দার্শনিকের ন্যায় ভূমিকা রেখেছেনবঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে নতুনরূপে আন্দোলন, সংগ্রাম চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেনতিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অনেক সভায় অংশগ্রহণ ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দিতেনসেজন্য প্রায়ই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বাড়িতে আসত ও আগত অতিথিদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখতএ সময় ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়িটির নির্মাণ কাজ চলমান ছিলবঙ্গমাতা বাড়ি নির্মাণের কাজ তদারকি করতেন এবং প্রায়ই নিজে বাড়ি নির্মাণে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতেনআজকের ৩২ নম্বরের বাড়ির সঙ্গে বঙ্গমাতার অসংখ্য স্মৃতি ও মূল্যবান শ্রম জড়িয়ে আছেপ্রধানমন্ত্রী এক ভাষণে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, বাঙালী জাতি স্বাধীন জাতি হবে, পৃথিবীতে আর কেউ না জানলেও আমার মা যে জানতেন, সেটা এখন যখন সমস্ত পেছনের জিনিসগুলো চিন্তা করি তখন মনে হয় আমার মা  তো সবই জানতেনআমার মা ছিলেন আসল গেরিলাতিনি নিজেকে অন্যভাবে ক্যামোফ্লেজ করে আন্দোলন গড়ে তুলেছেনআন্দোলন যে কিভাবে করতে হয়, সেটা আমার মায়ের কাছ থেকেই শেখা, দেখা

আগস্ট মাস শোকের মাসস্বজন হারানোর মাস১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকা-ে নিহত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছিজাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার সময় ছোট শিশুপুত্র রাসেলসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকেও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়বঙ্গমাতাকে খুনীরা বলেছিল, ‘আপনি চলেনতিনি বললেন, ‘কোথাও যাব নাওনাকে খুন করেছ, আমাকেও শেষ করে দাওআমি এখান থেকে এক পাও নড়ব নামৃত্যু অনিবার্য জেনেও সবাই এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়কারণ, মানুষ তাঁর নিজের জীবনকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে বলেই জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়কিন্তু বঙ্গমাতা জীবন বাঁচাতে আকুতিমিনতি করেননি

তিনি খুনীদের কাছে জীবন ভিক্ষা চাননিবীরের মতো বুক পেতে দিয়েছিলেন বুলেটের সামনেবঙ্গবন্ধুর আজীবন সুখে-দুঃখে, সঙ্কটে, সংগ্রামের সহযাত্রী মৃত্যুকালেও তাঁর সহযাত্রী হয়ে রইলেনবিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি চিরস্থায়ীতাই পরাজয়ের গ্লানি মোচন করার উদ্দেশ্যেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়বিশ্বে অনেক দেশে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান ও রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু কোথাও সপরিবারে হত্যা করা হয়নিবঙ্গবন্ধু পরিবারের কোন সদস্যের নেতৃত্বে স্বাধীনতার মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে না পারে সেজন্যই সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়রাখে আল্লাহ মারে কে? জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বিদেশে থাকার কারণে সেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যÑ শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা প্রাণে বেঁচে যানবঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতি ফিরে পায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার জীবনাদর্শের অনুপ্রেরণায় তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সারাবিশ্ব দেখছে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও সফলতার ক্ষেত্রে উন্নয়নের ম্যাজিকদেশের উন্নয়ন তিনি এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে, একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ হতে চায়কেননা সামাজিক উন্নয়নের প্রধান ১০ সূচকের সব ক্ষেত্রে পরাজিত পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ থেকে পিছিয়েদেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত উপেক্ষা করে প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করে প্রমাণ করেছেন শেখ হাসিনাও পারেনবাংলাদেশও পারেপদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের উক্তি তোমরা আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা নাবঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ জুন ২০২২ তারিখে বাংলাদেশের আপামর মানুষের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা এবং গৌরবের প্রতীক পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণ করেছেনপদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে ২১টি জেলার যোগাযোগ ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত হয়েছেপদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি অন্তত ২.৫ শতাংশ বাড়বেসামগ্রিকভাবে দেশের জিডিপি আরও ১.২৩ শতাংশ বাড়বেরাজধানীতে মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ একদম শেষের দিকে এবং উদ্বোধন হবে অতিশীঘ্রইদেশের ইতিহাসে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেনারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি

এ বছরের ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মায়ের অনুপ্রেরণা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সবসময় আমি এটা অনুভব করি যে আমার মা, আমার বাবা সবসময় তাদের দোয়া আমার ওপর রেখেছেনতাদের আশীর্বাদের হাত আমার মাথায় আছেতা নইলে আমার মতো একটা সাধারণ মানুষÑ যে অতি সাধারণ বাঙালী মেয়ে, এত কাজ করতে আমি পারতাম না যদি আমার বাবা-মায়ের দোয়া, আশীর্বাদের হাত আমার ওপর না থাকতএ বছরের প্রতিপাদ্য মহীয়সী বঙ্গমাতার চেতনা, অদম্য বাংলাদেশের প্রেরণা’, যথার্থ এবং সময়োপযোগীবঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে যেমন মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা যায় না, তেমনই বঙ্গমাতাকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়সরকার ২০২১ সাল থেকে বঙ্গমাতার অবদান চিরস্মরণীয় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাঁচজন বিশিষ্ট নারীকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক প্রদান করছেবঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব যে সততা, মহানুভবতা, উদারতা ও আদর্শের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা যুগে যুগে বাঙালী নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উস হয়ে থাকবেতাঁর সংগ্রামী জীবন, বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অনেক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবেএই মহীয়সী নারীর জীবনচর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে

লেখক : সংসদ সদস্য, প্রতিমন্ত্রী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়

×