
২৬ মার্চ, ১৯৭১ সালে বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল এক নতুন সূর্য। এ সূর্যের রক্তিম আভা ছুঁয়েছিল সকল বাঙালীর প্রাণ। এ সূর্য ছিল নব অভ্যুদয়ের, স্বাধীনতার। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরুর পরপরই স্বাধীনতার ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিপ্রাণ বাঙালী মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। জন্ম হয় নতুন এক রাষ্ট্রের। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। যে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল বৈষম্য নিরসন ও অর্থনৈতিক মুক্তি। আজ সেই স্বাধীনতার একান্নতম বার্ষিকী। বায়ান্ন বছরে এসে বাংলাদেশ অনেকটাই বদলেছে। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। যার ফলে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রই ডিজিটাইজড হচ্ছে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। সরকারের এই ভিশনকে বাস্তবায়ন করতে হলে কাজে লাগাতে হবে তথ্যপ্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে।
বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হয়। বঙ্গবন্ধু দেশের উন্নয়নের জন্য যেসব পরিকল্পিত কর্মসূচী হাতে নিয়েছিলেন সেদিকে নজর দিলেই তা স্পষ্ট হবে। স্বাধীনতার দুই বছরের মধ্যে ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ দেন। কৃষি, শিক্ষা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যের মতো তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও নজর দেন সমানভাবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আর্থ-সামাজিক জরিপ এবং আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হয়। তার শাসনামলে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ স্টেশনের যাত্রা শুরু। শিক্ষা খাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করার মতো দূরদর্শী চিন্তাও করেছিলেন তিনি। তবে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে থেমে যায় বাংলাদেশের অগ্রপথিকের জীবন। এর সঙ্গে থেমে যায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে ব্যাহত হয় উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। তবে বঙ্গবন্ধুর কন্যার হাত ধরে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেন তিনি। এখন সারাবিশ্ব প্রযুক্তিতে যেভাবে এগিয়েছে বাংলাদেশও সেই চেষ্টা করছে।
সব ক্ষেত্রেই বর্তমান সরকারের সাফল্য এসেছে। তবে কাক্সিক্ষত সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথেই রয়েছে সরকার। ২০৪১ সাল নাগাদ যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা বাস্তবায়নে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারে যে ফারাক রয়েছে তা নিরসন করতে হবে। দেশের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। এছাড়াও সেবামূলক খাতগুলোতে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরী। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্পের অংশ হিসেবে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেটের আওতায় এসেছে। লাখ লাখ মানুষের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে। তারুণ্যের মেধা ও শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের প্রযুক্তিগত মুক্তি অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম তখন দেশের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। এখন সেই বাজেটের আকার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ হাজার কোটি টাকা। তখন ১২৯ ডলারের মাথাপিছু আয়ের বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে হয়েছে ২৫৯১ ডলার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এটি একটি অভাবনীয় সাফল্য। ২০১৯ সালে আইসিটি খাতে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি আয় করেছে বাংলাদেশ। বিশ্বে ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। যে কোন সময় জরুরী সেবা দিতে সরকার চালু করেছে ইমারজেন্সি কল সার্ভিস ‘৯৯৯’। এছাড়া অন্যান্য জরুরী সেবা দিতেও কল সেন্টার চালু করা হয়েছে। কল সেন্টারে বিনামূল্যে সেবা গ্রহণ করা যাচ্ছে। গ্রামের মানুষের হাতে হাতে মুঠোফোন। এসব মুঠোফোন আবার রয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। গ্রামের শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষের অধিকাংশই এখন ইন্টারনেট সেবার আওতায় এসেছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ দৈনন্দিন অনেক সেবা গ্রহণ করছে। এভাবে সব কাজ অনেকগুণ সহজ হয়েছে। যেসব সেবা পেতে আগে উপজেলা, জেলা কিংবা রাজধানীতে আসতে হতো সেগুলো এখন গ্রামেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাওয়া যায়। ইন্টারনেট ও মুঠোফোনের মতো প্রযুক্তির ছোঁয়ায় মানুষের হাতের মুঠোয় সব সেবা এসে পৌঁছেছে। বর্তমানে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আয় ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। হাই-টেক এবং আইটি পার্ক রয়েছে ৩৯টি। যার মধ্যে ৭টিতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে।
সরকার এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংসের (আইওটি) মতো ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা কাজে লাগানো ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অর্থাৎ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জকে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে উন্নয়নের পথ অবলম্বনে জোর দিয়েছে সরকার। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইওটি, রোবোটিক্স, সাইবার সিকিউরিটির উচ্চ প্রযুক্তির ৩১টি বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রান্তিক স্কুল-কলেজ পর্যায়েও ডিজিটাল ল্যাব সুবিধা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পাঠ্যসূচীতে তথ্যপ্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত ব্যবহারিক এবং তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকছে। এভাবে তারা তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে উঠছে। দেশে চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তিগত সেবা চালু হয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে পঞ্চম প্রজন্মের (ফাইভ-জি) প্রযুক্তি চালুর লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
অন্যান্য খাতের মতোই দেশে প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রার সাফল্য সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। ১২ বছর আগে কেউ কল্পনাও করেনি ট্রেনের টিকেট ঘরে বসে অনলাইনেই সংগ্রহ করা যাবে, কিংবা মোবাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া সম্ভব। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ এসেছে ইন্টারনেটের সেবার আওতায়। ২০১৭ সালে সাউথ-সাউথ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সোমালিয়া, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, ফিজি, ফিলিপিন্স ও প্যারাগুয়ের সঙ্গে সমঝোতা হয়। যার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), ওপেন গভর্নমেন্ট ডাটা, চেইঞ্জ ল্যাবসহ বিভিন্ন বিষয়ক জ্ঞান অর্জনসহ সেবা আদান-প্রদানের ব্যবস্থা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সরকারের লক্ষ্যের চেয়েও বেশি অর্জিত হয়েছে। তবে সরকারের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য এখনও অর্জিত হয়নি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন এবং সরকারের ভিশন ২০৪১ সফলভাবে অর্জন করার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত। তাই এই খাতকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগানোর উপযোগী হিসেবে প্রস্তুত করার পাশাপাশি দক্ষ জনবল তৈরিতে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)