ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২১ জুলাই ২০২৫, ৬ শ্রাবণ ১৪৩২

অভিজাত্যের অনুষঙ্গ ধূমপান: এক সামাজিক ব্যাধি 

মশিউর রহমান

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ২১ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০৮:৩৫, ২১ জুলাই ২০২৫

অভিজাত্যের অনুষঙ্গ ধূমপান: এক সামাজিক ব্যাধি 

ছবিঃ সংগৃহীত

সম্প্রতি রাজধানীর একটি প্রাকৃতিক ছায়ায় গড়ে ওঠা অভিজাত রেস্তোরাঁয় বসে একটি ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ল। সাধারণত উচ্চবিত্ত, শিক্ষার্থী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের আনাগোনা যেখানে বেশি, সেই অভিজাত্যপূর্ণ পরিবেশে ধূমপানের এক অস্বাভাবিক প্রবণতা চোখে পড়ল। অবাক করার মতো বিষয় হলো, এই প্রবণতা কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বয়স্ক, মধ্যবয়সী এবং তরুণ—সব বয়সী মানুষের মধ্যেই ধূমপানকে অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং আভিজাত্যের অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে দেখা গেছে।

রেস্তোরাঁর পরিবেশে লক্ষ্য করা গেল, প্রবীণ ব্যক্তিরা ধীরেসুস্থে তাদের সিগারেট শেষ করছেন, যেন তা তাদের দৈনন্দিন আভিজাত্যপূর্ণ জীবনেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মধ্যবয়সীরা হয়তো গল্পের আলাপে, ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ফাঁকেই আয়েশ করে ধূমপান করছেন, যা তাদের পেশাদার জীবনের এক ধরনের চাপমুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, তরুণ প্রজন্মকে দেখা গেল আধুনিকতার প্রতীক হিসেবেই সিগারেট হাতে নিয়ে নিজেদের প্রকাশ করতে। তাদের কাছে এটি যেন কেবল একটি অভ্যাস নয়, বরং সামাজিক অবস্থানের এক প্রতীকী অংশ।

এই দৃশ্য সমাজের প্রচলিত ধারণাকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। যেখানে ধূমপানকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং অনুচিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেখানে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে এর এমন অবাধ বিচরণ প্রশ্ন তোলে। এটি কি কেবল ব্যক্তিগত পছন্দ, নাকি সামাজিক আভিজাত্যের এক অলিখিত অনুষঙ্গ?

এই প্রবণতা নিয়ে কথা হয় সমাজের বিভিন্ন স্তরের অধূমপায়ী মানুষের সঙ্গে। তাদের মতামত এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল এবং গভীর করে তোলে।

নুরুল আলম (৩২), পেশায় একজন ব্যবসায়ী, এই চিত্রকে ভ্রান্ত আভিজাত্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, "ব্যবসায়িক মিটিংয়ে অনেক সময় দেখি, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের আগে বা পরে ধূমপান করা হয়। যেন এটা এক ধরনের 'ক্লারিটি' বা চিন্তার স্বচ্ছতা দেয়। কিন্তু আমি মনে করি, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং ধোঁয়ার কারণে পরিবেশ দূষিত হয় এবং আমাদের মতো যারা অধূমপায়ী, তাদের জন্য সেটা অসহনীয়। আভিজাত্য মানে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অন্যকে অস্বস্তিতে না ফেলা।" তিনি আরও যোগ করেন, "ধূমপান কখনোই কোনো ইতিবাচক বা সম্মানজনক অভ্যাস হতে পারে না, বরং এটি স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর এবং সমাজের জন্য একটি বোঝাস্বরূপ।"

মুজাহিদুল ইসলাম (২৭), একজন ছাত্র, এই বিষয়টিকে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে দেখেন। তিনি বলেন, "কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সিনিয়র ভাই বা বন্ধুকে দেখেছি, যারা আভিজাত্য বা স্মার্টনেস দেখানোর জন্য ধূমপান শুরু করে। তাদের ধারণা, সিগারেট হাতে নিলে বুঝি ব্যক্তিত্ব বাড়ে। এটা খুবই দুঃখজনক। ধূমপান যে কতটা ভয়ংকর একটা জিনিস, ক্যানসার থেকে শুরু করে ফুসফুসের রোগ—এগুলো তারা ভুলে যায়। আভিজাত্য বা আধুনিকতার নামে নিজেদের এবং অন্যদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলাটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।" তিনি আরও দৃঢ়ভাবে বলেন, "ধূমপানের মাধ্যমে আভিজাত্য দেখানো একটি ভিত্তিহীন ধারণা যা যুবসমাজকে বিপথে চালিত করছে। আমাদের উচিত এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।"

সবচেয়ে মর্মস্পর্শী মতামতটি আসে মুবিরুল ইসলাম রবি (৮) নামে একজন আট বছর বয়সী ছাত্রের কাছ থেকে। সে জানায়, "আমার বাবা সিগারেট খায় না। আমার চাচা খায়। যখন চাচা সিগারেট খায়, তখন আমার কাশি হয়। মা বলে, সিগারেট খারাপ। যারা সিগারেট খায়, তাদের শরীর খারাপ হয়। তাহলে কেন মানুষ সিগারেট খায়?" তার নিষ্পাপ প্রশ্নটি যেন সমাজের ধূমপান প্রবণতার উপর এক কঠিন আঘাত। শিশুদের চোখে ধূমপান শুধুই ক্ষতির কারণ, সেখানে আভিজাত্যের কোনো স্থান নেই।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ধূমপান একসময় স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে বিবেচিত হতো, এবং সেই ধারণা এখনো সমাজের কিছু স্তরে বিদ্যমান। তাছাড়া, উচ্চবিত্তদের মধ্যে মানসিক চাপ এবং কাজের ব্যস্ততাও ধূমপানের অন্যতম কারণ হতে পারে, যা তাদের কাছে এক ধরনের স্বস্তিদায়ক অভ্যাস। তবে, তরুণদের মধ্যে এর বিস্তার বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অথবা সামাজিক চাপ থেকে তারা ধূমপানকে আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা জরুরি।

এই চিত্র একদিকে যেমন ধূমপানবিরোধী জনসচেতনতা কার্যক্রমে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ধূমপানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। আভিজাত্যের মোড়কে ধূমপানের এই স্বাভাবিকীকরণ জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে, তা নিয়ে এখনই ভাবার সময় এসেছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে, বিশেষ করে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে ধূমপান-মুক্ত জীবনযাপনকে সত্যিকারের আভিজাত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যাপক জনসচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম জরুরি।

আমাদের কি এই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ানো উচিত নয় এবং আইনের প্রয়োগ আরো জোড়ালো করা উচিত?

লেখকঃ মশিউর রহমান, বাউফল, পটুয়াখালী

নোভা

×