
২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় ছয় লাখ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে আমরা কীভাবে দেখছি? একজন ছাত্র এক বা দুই বিষয়ে ফেল করলে তাকে পুরো এক বছর বসিয়ে রাখা কি কোনোভাবেই যৌক্তিক? এই এক বছরের ‘শাস্তি’ শুধু তাদের ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও এক বিশাল ক্ষতি। বরং এক বা দুই বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিয়ে আমরা তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক বছর সময়কে নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারি।
যে শিক্ষার্থীরা এক বা দুই বিষয়ে ফেল করেছে- তাদের অনেকেই শিক্ষাজীবনে মোটামুটি ভালো করছিল। অথচ আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা অনুযায়ী, তারা পুরো এক বছর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থাকবে, এরপর পুনরায় ফেল করা বিষয়ের পরীক্ষা দেবে, এবং তারপরে কলেজে ভর্তি হতে পারবে। এই এক বছরের ‘শাস্তি’ অনেক সময় তাদের জীবনের গতি থামিয়ে দেয়। মানসিকভাবে তারা বিপর্যস্ত হয়, আত্মবিশ্বাস হারায় এবং অনেকেই সামাজিক বিদ্রুপ বা পরিবারের চাপে পড়েন। কিছু শিক্ষার্থী এই ফাঁকা সময়টাতে অপরাধ বা মাদকসহ নানা ঝুঁকিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে।
এই ক্ষতির মাত্রা এখানেই শেষ নয়। পুরো জাতি অর্থনৈতিকভাবে এই শিক্ষাব্যবস্থার চরম মূল্য দিচ্ছে। যদি এই বছর সময় নষ্ট না হয় এবং এই ছয় লাখ শিক্ষার্থী নিয়মিত পড়াশোনা করে এক বছর আগে শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মবাজারে প্রবেশ করতে পরে, তাহলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) তারা কী পরিমাণ অবদান রাখতে পারত? একটু সহজ হিসেব করি: একজন ব্যক্তি মাসে মাত্র ১০,০০০ টাকা আয় করলেও, ছয় লাখ শিক্ষার্থী এক বছর আগে কর্মে যুক্ত হলে অর্থনীতিতে যোগ হতো ৬০০,০০০ × ১০,০০০ × ১২ = ৭২,০০০,০০০,০০০ টাকা, অর্থাৎ ৭,২০০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, এই একটি নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমরা ছয় লক্ষ শিক্ষার্থীর এক বছর বসিয়ে রেখে সাত হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি করছি—যা খুব সহজেই প্রতিকারযোগ্য। এই সমস্যার দুটি সহজ সমাধান আছে।
প্রথমত, যেসব শিক্ষার্থী এক বা দুই বিষয়ে ফেল করেছে, তাদের শর্তসাপেক্ষে কলেজে ভর্তি করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তারা কলেজে ভর্তি হয়ে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যাবে এবং পরবর্তী বছরে ফেল করা বিষয়ের পুনঃপরীক্ষা দিয়ে পাস করার সুযোগ পাবে। এইভাবে তারা এক বছর হারাবে না এবং এইচএসসি পরীক্ষাও সময়মতো দিতে পারবে। তাদের পরবর্তী পড়াশোনা চালিয়ে যেতেও কোন অসুবিধা হবে না।
দ্বিতীয়ত, আমাদের নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে সেমিস্টারভিত্তিক করা যেতে পারে। এতে করে শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে এগিয়ে যাবে এবং কোনো বিষয়ে ফেল করলে সেটি পরবর্তী সেমিস্টারে বা বছরে পুনরায় দেওয়ার সুযোগ পাবে- একটা পুরো বছর নষ্ট না করে। চার বছরে তারা এসএসসি ও এইচএসসির সব বিষয় পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। এ পদ্ধতিটা অনেকটা আমেরিকার চার বছরের হাইস্কুল শিক্ষার মতো হবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই এমন ব্যবস্থা চালু আছে, যেখানে ব্যর্থতা মানেই পুরো এক বছর হারানো নয়, বরং পুনরুদ্ধারের সুযোগ রাখা হয়। বাংলাদেশে আজকের দিনে ছয় লাখ শিক্ষার্থী ফেল করলে তা শুধু তাদের নয়, আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, মূল্যায়ন পদ্ধতি ও সামাজিক মনোভাবেরই একটি ব্যর্থতার প্রতিফলন।
এই শিক্ষার্থীরা আমাদের ভবিষ্যৎ শ্রমশক্তি। তাদের শুধু একটি বা দুটি বিষয়ে ব্যর্থতার কারণে পুরো এক বছর সমাজ ও অর্থনীতি থেকে আলাদা করে রাখা মানে এই দেশের সম্ভাবনাকে পিছিয়ে দেওয়া। সময় এসেছে, আমরা নীতিনির্ধারক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা একসঙ্গে বসে একটি সহানুভূতিশীল, কার্যকর ও ভবিষ্যতমুখী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করি- যেখানে একটি ছোট ব্যর্থতা একজন শিক্ষার্থীর জীবনের বড় ব্যর্থতায় পরিণত না হয়।
এসএসসি ফেল মানেই জীবন ফেল নয়। তাই এখনই সময় ব্যবস্থা বদলের।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ
প্যানেল/মো.