
দুর্গম অঞ্চল থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ করলেও সমুদ্র সম্পদের প্রতি এক ধরনের অনীহা রয়েছে মানুষের। অথচ দুর্গম অঞ্চলের খনিজ সম্পদের তুলনায় সমুদ্রসম্পদ আহরণ কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও প্রচুর লাভজনক। যেমন, একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে মৎস্য আহরণ ও লবণ উৎপাদন। এ দুটি ক্ষেত্রে খুব বেশি অর্থলগ্নির প্রয়োজন পড়ে না। অথচ কোটি কোটি টাকা লাভবান হচ্ছেন লগ্নিকারীরা। এ দুটি সেক্টরে বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি অর্থলগ্নি না থাকলেও অনেক সময় প্রণোদনা দিয়ে থাকেন সরকার। তাতে করে লগ্নিকারীরা উজ্জীবিত হয়ে থাকেন যেমন, তেমনি সমুদ্রসম্পদ আহরণ করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে দেশের বাইরে রপ্তানি করে বিপুল রাজস্বের জোগান দেন তারা।
সবাই জানেন, সমগ্র বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ স্থলভূমি, বাদবাকি তিন ভাগ জলরাশিতে ভরপুর। তার মধ্যে বেশিরভাগই সমুদ্রবেষ্টিত জলরাশি। উদাহরণ হচ্ছে, মাত্র এক ভাগ স্থলভূমির মধ্যে শত শত ধরনের খনিজ পদার্থ বিদ্যমান থাকলে বাকি তিন ভাগে কী পরিমাণ সম্পদ থাকতে পারে তা অনুমেয়। এই হিসাব-নিকাশের জন্য কাগজ-কলম নিয়ে অঙ্ককষার প্রয়োজন নেই, সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট। অনেকের উপলব্ধি জলতলে আবার কিসের সম্পদ! সে উপলব্ধি নিবৃত্তির প্রয়াসে ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান দাখিল করার চেষ্টা করছি আমরা।
সমীক্ষায় জানা গেছে, সমুদ্রে ৫০টির অধিক অতি প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। উল্লেখযোগ্যের মধ্যে, বালু, ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম, মোনাজাইট, জিরকন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, জিংক, আয়োডিন, অ্যালুমিনিয়াম, ফসফরাস, লিথিনিয়াম, সালফার, সিলিকন, কপার, নাইট্টোজেন, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, বোরন, স্বর্ণ, জ্বালানি তেল, গ্যাস, ক্লে (সিমেন্টের কাঁচামাল), দ্রবীভূত লবণসহ হরেক খনিজ পদার্থ। অপরদিকে জলজ প্রাণিদের মধ্যে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩৬০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া, অক্টোপাস, হাঙরসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণিজ সম্পদ রয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এছাড়াও আমাদের সমুদ্র সীমানায় প্রচুর টুনা মাছ পাওয়া যায়, যা খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি এ মাছের আন্তর্জাতিক চাহিদা ব্যাপক। উল্লেখ্য, আমাদের দেশেও টুনা মাছের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিচ এলাকায় পর্যটক বেড়াতে এলে টুনা মাছের বারবিকিউ তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে।
অন্যান্য খনিজ পদার্র্র্থের তুলনায় সমুদ্রে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তার পরেই হচ্ছে সালফার। মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে কিংবা খাদ্যের স্বাদ ফিরিয়ে আনতে হলে লবণের বিকল্প নেই। যা জোগান দিচ্ছে সমুদ্রের জলরাশি। অপরদিকে সালফারের প্রয়োজনীয়তা স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করার নয়। শুধু সালফার নয়, প্রতিটি খনিজ পদার্থের প্রয়োজনীয়তা স্বল্প সময়ের মধ্যে কিংবা স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। উপরে ইউরেনিয়ামের কথা উল্লেখ করা হলেও এই খনিজ পদার্থের প্রয়োজনীয়তা ও সমুদ্রতলে মজুতের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। অন্যান্য খনিজ পদার্থ সম্পর্কে তেমন একটা আলোচনা করা না হলেও ইউরেনিয়াম সম্পর্কে আমরা সামান্য আলোচনা করার চেষ্টা করছি। কারণ এটি একটি দুষ্পাপ্য খনিজ পদার্থ। বিশ্ববাজারে ইউরেনিয়ামের দাম যেমন চড়া তেমনি রয়েছে ব্যাপক চাহিদাও।
সমীক্ষায় জানা যায়, কোনো স্থানে ইউরেনিয়ামের মাত্রা ৭ শতাংশ হলে বাণিজ্যিকভাবে সেটি উত্তোলনের উপযুক্ত হয়। সেই মতে আমাদের সমুদ্রসীমানায় বিশেষ করে উপকূলীয় কিছু অংশে বাণিজ্যিকভাবে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের মতো মজুত রয়েছে। ইউরেনিয়াম শুধু বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকাই নয়, বিশ্বের সমগ্র সমুদ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত রয়েছে যার পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন টন। যা উত্তোলনে পরিবেশের ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটার কথা নয়। খনি থেকে ইউরিনিয়াম অরহণ খুব বিপজ্জনক হলেও সমুদ্রের তলদেশ থেকে ইউরিনিয়াম উত্তোলন তুলনামূলক নিরাপদ। অন্যদিকে প্রতি ঘনমাইল সমুদ্রজলে প্রায় ২৫ টন স্বর্ণ মজুতের তথ্যও জানা গেছে। জানা গেছে, অফুরন্ত গ্যাস এবং জ্বালানি তেলের মজুত সম্পর্কেও। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার পাশেই মিয়ানমার ইতোমধ্যে বড় ধরনের গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছেও। বিশেষজ্ঞদের ধারণা আমাদের সমুদ্রসীমানায় তারচেয়েও বড় ধরনের গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, যা আমাদের অতিশীঘ্রই সন্ধান করে নিশ্চিত হতে হবে এবং সেটি উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ আর মাত্র ১০ বছর অর্থাৎ ২০৩১ সাল পর্যন্ত আমাদের গ্যাস মজুত থাকবে। ভূপৃষ্ঠের গ্যাস পুরিয়ে যাওয়ার আগেই সমুদ্রে রক্ষিত গ্যাসের ওপর আমাদের নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে উত্তোলন সম্ভব না হলেও ভারত ও মিয়ানমার থেকে অর্জিত সমুদ্রসীমায় ২৬টি ব্লক ইজারা দিয়ে সেখান থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ সমুদ্রের খনিজ সম্পদ উত্তোলনের অভিজ্ঞতা ভারত, মিয়ানমারের রয়েছে। তারা সমুদ্রের তেল-গ্যাস উত্তোলন করে নিজেদের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে ইতোমধ্যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তেমনি গ্যাসের মতো ইউরেনিয়ামের ক্ষেত্রেও ইজারার মাধ্যমে আহরণ সম্ভব। কারণ ইউরেনিয়ামের ব্যবহার দেশে খুব দ্রুততর হতে যাচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে ইউরেনিয়ামের প্রয়োজনীতা দেখা দিবে। আমাদের বিশ্বাস সঠিক সময়ে উত্তোলনের ফলে সেই প্রয়োজনীতা মিটে যাবে অনায়াসেই।
শুধু নীল সমুদ্রই নয়, সমুদ্রোপকূলেও রয়েছে অগাধ সম্পদ। সমুদ্রোপকূলে এ পর্যন্ত ১৭ প্রকার খনিজ বালুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইলমেনাইট, জিরকন, রোটাইল, গ্যানেট, ম্যাগনেটাইট উল্লেখযোগ্য। ধারণা করা হচ্ছে, সমুদ্রোপকূলেও প্রায় ১.২৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালু রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য ১২ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখ্য, নদী থেকে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্যে আঘাত হানলেও সমুদ্রোপকূলের বালু আহরণে সেই ধরনের ঝুঁকি নেই।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সুনীল অর্থনীতি কাজে লাগাতে পারলে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশের পক্ষে আয় করা সম্ভব। যার জন্য সমুদ্রে রক্ষিত প্রাণিজ সম্পদ, অপ্রাণিজ বা খনিজ সম্পদ উত্তোলনের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে করে দেশ যেমন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে, তেমনি বেকারদেরও কর্মস্থান হবে। তা ছাড়া এসব অতি প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ উত্তোলন এবং সঠিক ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই বিত্তশালী দেশে পরিণত হতে পারবে বলে আমাদের অগাধ বিশ্বাস রয়েছে। আরেকটি কথা হচ্ছে, ভূপৃষ্ঠের সম্পদ যতটা নিরাপদে আগলে রাখা সম্ভব, ততটা নিরাপদ নয় সমুদ্র সম্পদ। বিশেষ করে প্রাণিজ সম্পদের কথাই ধরা যাক, এ সম্পদের মধ্যে স্থিরতা নেই, যে কোনো সময় সীমানা অতিক্রম করতে পারে অথবা সীমানা ডিঙ্গিয়ে কেউ কেউ আহরণ করে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং সেসব চিন্তা মাথায় নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সমুদ্র সম্পদ আহরণ করা যায়, ততটাই মঙ্গল আমাদের জন্য।
লেখক : পরিবেশ ও জলবায়ুবিষয়ক লেখক
প্যানেল/মো.