
গত কয়েক বছরে ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার চর চান্দিয়া, জমাদার বাজার, মতিগঞ্জ ও আমিরাবাদসহ অনেক জনপদ শান্তিপূর্ণ স্থানীয় এলাকা থেকে দুশ্চিন্তার কেন্দ্রস্থল মাদকাসক্তির কবলে পরিণত হয়েছে। একসময়ের শান্তিময় কৃষি-ভিত্তিক সমাজ এখন দিনের পর দিন দেখা যাচ্ছে বাড়তে থাকা অপরাধ, অবিচারের কাহিনী, একাকী পরিবার আর নৈতিক-মূল্যবোধের ধ্বংসস্তূপের দিকে ধাবিত চিত্র। যুব সমাজ বারবার হাতছাড়া হচ্ছে নিষ্ঠুর মাদকের গহ্বরের দিকে।
এর মূলে রয়েছে জটিল সমস্যার জাল : দুর্বল আইনশৃঙ্খলা, অভিভাবকদের অনুপস্থিতি, শিক্ষা ও চাকরির অভাব এবং একটি অবাধ পরিবেশ, যা অপরাধীদের নানা সুযোগ এনে দেয়। এর ফলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নিরাপত্তাহীনতা, যুব সমাজে হতাশা, পারিবারিক কলহ এবং এরূপ নানা ধরনের সংকট চরম রূপ ধারণ করেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন অন্তত ৫-৭টি পরিবারে মাদকের বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের প্রবীণরা জানান, আগে যেখানে কেবল বিড়ি-সিগারেটের প্রচলন ছিল, এখন সেখানে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল এবং নানা রকমের কৃত্রিম মাদকের ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। অনেক শিক্ষিত পরিবারও এমন করুণ বাস্তবতার শিকার। যেখানে পিতামাতার শেষ বয়সে সন্তানের সেবা-যত্ন পাওয়ার কথা, সেখানে মাদকাসক্ত সন্তানের কারণে তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ ও নিরাপত্তাহীন।
এমতাবস্থায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, সময় এসেছে চরম সিদ্ধান্তের; আর না হলে গোটা অঞ্চল বিপদসংকুল ও অনিবার্য গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। সোনাগাজীর এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি কেবল স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলের একটি ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। দেশের অন্যান্য উপজেলাতেও অনুরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
এই এলাকার গ্রামীণ জনগণ বারবার পুলিশের উপস্থিতির অভাব কিংবা কেবলমাত্র প্রদর্শনীর জন্য আসার বিষয়ে অভিযোগ করেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কয়েকটি গাড়ি বা মোবাইল টিম আসে, কিন্তু তারা আসে ঘটনার পর তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেওয়ার আগে অনেকটা বিলম্বে। মাদকাসক্ত বা মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হলেও দ্রুত জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়। তাদের গা ঘেঁষেই আবার শুরু হয় সেই একই অভিযান। একটি ভয়ংকর নিয়ম দেখা যাচ্ছে : গ্রেফতার করা, জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার স্বরূপে ফিরে আসা। এদের এমন প্রভাব রাজনীতি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। তাই দেশজুড়ে সক্রিয় অভিযানের পরও, গ্রামের চারপাশে নদীর পথ ও ঘাটে ক্রমাগত যাতায়াতের ফলে আইনশৃঙ্খলা-রক্ষাকারীরা নিজেদের কার্যকর শক্তি ও রাজনৈতিক সমর্থন প্রদর্শনে ব্যর্থ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মাদক ব্যবসায়ীদের আরও সাহসী করে তুলেছে।
সোনাগাজীর বাসিন্দারা বারবার উল্লেখ করেছেন যে, অভিভাবকদের অনুপস্থিতি এই সমস্যার অন্যতম কারণ। পিতারা শহর বা বিদেশে প্রবাসে কাজ করেন, মায়েরা পারিবারিক জীবন পরিচালনার ভার বহন করেন, কিন্তু সন্তানের গতিবিধি জানার মতো সময় পান না। পরিবারের কাঠামো ভেঙে পড়ার কারণে যুব সমাজ নৈতিক নিয়ন্ত্রণ- ধারণা ও দায়িত্ববোধ- না পেয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চর চান্দিয়ার এক মায়ের ব্যথাযুক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় : তার ছেলে সকালে ঘর থেকে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে আসে না। ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে ইয়াবার জন্য টাকা সংগ্রহ করে। আরও মারাত্মক একটি ঘটনায় দেখা যায়, একটি মাদকাসক্ত ছেলে মাকে আঘাত করেছে টাকার জন্য। এলাকায় চুরি বেড়েছে। এই ঘটনাগুলো স্থানীয় বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছে এবং পরিবারের ভয়ানক দুর্বলতার ছবি ফুটে উঠেছে।
সারাদেশে শিক্ষার অবকাঠামো ভেঙে পড়ছে। চাকরি নেই, বিকল্প নেই- কৃষিতে আয় কম, কাজের সুযোগ নেই- বিকল্প পথ নেই। মাঝেমাঝে লোকেরা ঢাকায় যায়, আবার ফিরে আসে হতাশার বেদনা নিয়ে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ৪৩% বেকার নেশাগ্রস্তদের মধ্যে অপরাধে জড়িত হয়, যার ৮০% তরুণ পুরুষ। সোনাগাজীতেও এই অবস্থা প্রকট। শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের অভাব এবং স্থানীয় অর্থনীতির সীমাবদ্ধতা তরুণদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে। এই হতাশা থেকেই তারা মাদকের দিকে ঝুঁকছে। স্থানীয় কৃষি অর্থনীতিতে আধুনিকায়নের অভাব এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় তরুণরা বিপথগামী হচ্ছে।
গ্রামীণ মাদকাসক্তির জটিলতা সামলাতে সকল পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রথমেই আইনশৃঙ্খলাকে মজবুত করতে হবে। নির্দিষ্ট হটস্পট গ্রামে মোবাইল মাদক দমন টিম মোতায়েন করতে হবে, যেন তাদের স্বায়ত্তশাসিত তদন্ত ক্ষমতা থাকে। দ্রুত বিচার ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে- বিচার স্বচ্ছ ও দ্রুত হতে হবে। মাদক বিক্রেতার বিরুদ্ধে জামিন বাধ্যতামূলকভাবে সীমিত করে দিতে হবে এবং তাদের সম্পদ জব্দ করা দরকার। কমিউনিটি পুলিশিং চালু করতে হবে- যেখানে প্রত্যেক গ্রামবাসী সন্দেহজনক কার্যকলাপ রিপোর্ট করতে পারবে। পরিবার ও সমাজকে শক্তিশালী করতে স্কুল বা কমিউনিটি সেন্টারে পরিবারের কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে। পিতামাতা সমিতি গঠন করে সন্তানদের মনিটর করতে হবে- সক্রিয় যোগাযোগ রাখা জরুরি। ধর্মীয় নেতাদের উদ্যোগ নিতে হবে মাদকবিরোধী কর্মশালা, সামাজিক দায়িত্ব ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রচারে।
শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে দুর্গম ইউনিয়নের স্কুলগুলোর মানোন্নয়ন করতে হবে- প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও উপকরণ প্রদান করতে হবে। স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী ভোকেশনাল ট্রেনিং নিতে হবে- কৃষি, কারুকাজ, পরিবহন খাতের সঙ্গে যুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মাইক্রো-ক্রেডিট ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অর্থায়ন যুবকদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে একটি সরকার-সমর্থিত পুনর্বাসন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে- যেখানে মানসিক, চিকিৎসা ও বৃত্তিমূলক সেবা থাকবে। দরিদ্রদের জন্য বেসরকারি ক্লিনিককে সাবসিডি প্রদান করতে হবে এবং গ্রাম পর্যায়ের পুনর্বাসনী গ্রুপ গড়ে তুলতে হবে। এনজিওর কার্যক্রম যেমন আহ্ছানিয়া মিশনকে বিস্তৃতভাবে কাজে লাগাতে হবে।
মাদক সচেতনতাকে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্থানীয় ভাষায় রেডিও, পোস্টার, সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে মাদকের ঝুঁকি ও পুনর্বাসনের গল্প প্রকাশ করতে হবে। স্থানীয় তরুণদের উৎসাহিত করতে হবে- গানের আসর, নাটক, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার অনুষ্ঠান আয়োজন করে সতর্কতা গড়ে তুলতে হবে। জেলা পর্যায়ে মাদক প্রতিরোধ কাউন্সিল গঠন করতে হবে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এনজিও ও গ্রামের প্রতিনিধিরা থাকবেন। গ্রেপ্তার, দোষী সাব্যস্ত, চিকিৎসা ও পুনরাবৃত্তির পরিসংখ্যান ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রকাশ করতে হবে। গোপনীয় হেল্পলাইনের ব্যবস্থা করতে হবে, যা সন্দেহজনক কার্যকলাপ রিপোর্টিং প্রক্রিয়াকে নিরাপদ করে তুলবে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন মসজিদগুলোর বিশেষ প্রভাব রয়েছে- মসজিদ ও ইমামরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব। তারা মাদকমুক্ত জীবন, সামাজিক কল্যাণ, নৈতিক অখণ্ডতার ওপর ভিত্তি করে জনসভা করতে পারেন। এনজিও, ছাত্র গ্রুপ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের যুব শাখার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান চালু করতে হবে : খেলাধুলা, আলোচনা, কাউন্সেলিং। প্রাক্তন মাদকাসক্তদের সহায়ক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। প্রযুক্তির সাহায্যে অনামা রিপোর্টিং অ্যাপ চালু করতে হবে- যেন মানুষ পাচার বা সন্দেহজনক কার্যকলাপ রিপোর্ট করতে ভয় না পায়। স্কুলভিত্তিক র্যান্ডম মাদক পরীক্ষা চালু করা যেতে পারে- ছাত্রদের জন্য নিরুৎসাহিত করার উপায় হিসেবে। তরুণদের ক্ষমতায়ন করতে হবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মাদকবিরোধী কনটেন্ট তৈরি করতে- সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহার করে সমাজে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
মাদক সংকট দীর্ঘদিনের অবহেলার প্রতিফলন হলেও ভবিষ্যৎ নির্ধারিত নয়। আইনশৃঙ্খলা, পরিবার, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ- সবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি পরিবর্তন সম্ভব। তবে এই পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্থানীয় প্রশাসনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। সময় পর্যাপ্ত নেই; প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে একটি পূর্ণ প্রজন্ম। আজকের যে তরুণ মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, আগামীকাল সেই হতে পারে একটি সুস্থ পরিবারের কর্ণধার- যদি সঠিক সময়ে সঠিক হস্তক্ষেপ করা যায়।
এই চ্যালেঞ্জ শুধু সোনাগাজীর নয়; এটি বাংলাদেশের পরীক্ষার কাগজ। কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, টেকনাফ-কক্সবাজার- দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুরূপ পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, গ্রামীণ অঞ্চল কি প্রতিরোধ দেখাতে পারবে? যুব সমাজ কি জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাবে? স্থানীয় সরকার, সুশীল সমাজ, ধর্মীয় নেতা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। সামাজিক সংকল্পের মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করলে শক্তিশালী উপায় খুঁজে পাওয়া সম্ভব- এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে; চরম ক্ষতির আগেই- যদিও তা ইতোমধ্যে অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে।
লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল/মো.