ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিতে দ্যুতিময় পাঁচরুখী আনোয়ারা কলেজ

সোহেল রানা

প্রকাশিত: ১২:৫৬, ২৭ আগস্ট ২০২২; আপডেট: ১৪:০৯, ২৭ আগস্ট ২০২২

স্মৃতিতে দ্যুতিময় পাঁচরুখী আনোয়ারা কলেজ

কলেজ প্রাঙ্গণে শিক্ষকমণ্ডলীদের ফটোসেশান।


আমি একটা স্মৃতিচারণ লেখার তাড়না অনুভব করছি। জানি না, লেখাটা কতটা হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠবে। হয়তো লেখাটিতে সব অনুভূতি প্রকাশ না করতে পারার অক্ষমতাও ফুটে উঠতে পারে। চেষ্টা করবো হৃদয়ের সবটুকু দরদ দিয়ে লেখতে। ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে ক্ষমা করবেন। 

কোনো মানুষই স্থির নয়। ছুটে চলাই তার বৈশিষ্ট্য। সেই অর্থে আমিও ধাবমান স্রোতে ছুটে বেড়াচ্ছি। একবার ভেবেছি কী, পেছনে যে ফেলে এসেছি স্মৃতিময় অতীত। যে দিনগুলো রঙধনু'র মতোই মায়াময়। যে অতীত মায়ের ভালোবাসার মতোই স্নেহময়। তারপরও মনে হয়, কী যেনো নেই। কী যেনো হারিয়ে ফেলেছি! স্মৃতিগুলো এখনো আমার দু'চোখে দ্যুতি ছড়ায়। 

অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। কতো আশা, কতো স্বপ্ন। চোখে মুখে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার বাসনা। নিজেকে বদলানোর অবিরাম প্রচেষ্টা। আমার মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠা। বিবিধ টানাপড়েন। এসবের মধ্যেও সংকল্প বাঁধি, একদিনও বেকার থাকব না। অযথা সময় নষ্ট করব না। এই প্রত্যয়ে আমি ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শুনলাম, পাঁচরুখী কলেজে শিক্ষক নিবে। তা জানার পর সেখানে যোগাযোগ করলাম। দেয়া হলো ইন্টারভিউ। ক্লাস পারফরম্যান্স টেস্ট। তারপর এই কলেজ দিয়েই শুরু হলো আমার আনুষ্ঠানিক কর্মজীবন। যেখানে নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। যে স্মৃতি আমাকে উদ্দীপ্ত করে। অনুপ্রাণিত করে। যোগায় অনুপ্রেরণা। 

শিক্ষকতাই ছিল আমার প্রথম পছন্দের পেশা। এখনো এই পেশাকে হৃদয়ে ধারণ করি। স্বপ্ন বুনি, আবারও বিষয়ভিত্তিক ট্রপিক নিয়ে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করব। নতুন নতুন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করর। এই আশায় শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাও দিলাম। পাসও করলাম। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুযোগটা আর এল না। তাই আক্ষেপটাও রয়ে গেল।

সময়ের অপচয় না করে জীবিকার তাগিদে চলে আসলাম সাংবাদিকতা পেশায়। শুরুটা করলাম মফস্বল সাংবাদিকতার অনুসন্ধান রিপোর্ট দিয়ে। ওই সময় ফিচারও লিখতাম। সঙ্গে অন্যান্য প্রতিবেদন। ঢাকাতে এসে শুরু করি স্পোর্টস সাংবাদিকতা। ইচ্ছে ছিলো অর্থনীতি বিটে কাজ করবো। সেটা আর হলো না। এখন জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট সম্পাদনা করতে করতেই দিন কেটে যায়। কখনো কখনো দেখতে হয় বিনোদন ও জাতীয় নিউজ। আরো কত কী কাজ! দুটো পেশাতে আছে চ্যালেঞ্জ। আছে পেশাদারিত্বের আনন্দ। তিক্ততা যে নেই তা কিন্তু নয়। যেখানে আনন্দ আছে সেখানে বেদনাও অশ্রু হয়ে ঝড়ে।

শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত থাকলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় আনন্দ-উল্লাসে মাতামাতি করা যায়। তাদের মতামত শোনা যায়। যা অন্য কোনো পেশায় সম্ভব নয়। এ পেশার আরেকটি সুবিধা হলো, জ্ঞান চর্চার সঙ্গে থাকা যায় প্রতিনিয়ত। যদিও অনেক শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়িয়ে সময় কাটিয়ে দেন। কোনো টিচার আবার প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন শিক্ষার্থীদের। নিরূপায় হয়ে শিক্ষার্থীরাও পড়তে আসেন। এমনও দেখেছি, কোনো টিচাররা বেশি টাকা ইনকামের আশায় বাসায় গিয়েও পড়ান। এর ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। আবার কোনো কোনো টিচার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জ্ঞানের মুক্ত আলোচনা করে কাটিয়ে দেন সময়। চেষ্টা করেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত গড়ার। তাঁরা ধার ধারেন না অর্থ-বিত্তের। বেঁচে থাকতেন চান নিরবে-নিবৃত্তে আত্মসম্মান বোধ নিয়ে। 

লেখাটিতে একজন হৃদয়বান শিক্ষকের কথা না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন প্রিন্সিপাল (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ জাকির হোসেন স্যার। যিনি তরুণ শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের আগলে রাখতেন সবসময়। হেল্প করতেন নানাভাবে। সিনিয়র সহকর্মীরাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। সব ব্যাপারেই আমাদের মতো তরুণ টিচারদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। কখনো আলাদা করে ভাবতেন না কোন কিছু। আমরা যারা একই সময়ে নিয়োগ পেয়েছি তারা সবাই একই প্রতিষ্ঠানে অনার্স কোর্স সম্পন্ন করেছি। সেই হিসেবে আমরা সবাই পূর্ব পরিচিত। একই সঙ্গে আমাদের  যাওয়া-আসা হতো কলেজে।

মাস্টার্স পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ হলো। জাকির স্যারকে তা জানালাম। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করে বললেন, জীবনে একবারই তো মাস্টার্স পরীক্ষা দিবেন। বারবার তো আর দিবেন না। ছুটি নিয়ে চলে যান। পড়াশোনা করেন। তারপর, ভালোভাবে পরীক্ষা দেন। ক্লাসের বিষয়গুলো আমি দেখছি। আমরা ভাবছিলাম, একই সঙ্গে যদি সবাই পরীক্ষা দেয়ার জন্য চলে আসি তাহলে রুটিন মাফিক ক্লাসগুলো কীভাবে চলবে? কলেজের কী অবস্থা হবে? স্যার ঠিকই সবকিছু সামলে নিয়েছেন। আমাদেরও সুযোগ করে দিয়েছেন ভালোভাবে পরীক্ষা দেয়ার। আপনার আন্তরিক ভালোবাসায় আমি কৃতজ্ঞ স্যার।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচরুখী বেগম আনোয়ারা কলেজ। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে শিক্ষা বিস্তারের পরিসর। চালু হচ্ছে নানা বিষয়ের অনার্স কোর্স। যতটুকু জানি, কলেজটিতে প্রথমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয় মানবিক ও ব্যবসা শিক্ষা বিভাগ দিয়ে। এরপর চালু হয় বিজ্ঞান বিভাগ। তৃতীয় ধাপে চালু করা হয় ডিগ্রি কোর্স। চতুর্থ ধাপে প্রক্রিয়াধীন অনার্স কোর্স চালুর। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় চালুও হয়ে গেছে। এসব বিষয় সামনে রেখে অবকাঠামো উন্নয়নও হচ্ছে। শিগগিরই শুরু হওয়ার কথা, অনার্স ভবন নির্মাণের কাজ।

তিলে তিলে কলেজটি গড়ে তুলছেন জাকির স্যারই। এখনো সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কলেজকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করাই হচ্ছে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। স্যারের সাংগঠনিক দক্ষতায় আমি সবসময়ই মুগ্ধ। যা অনুসরণীয়। সঙ্গে নানা কাজে সহযোগিতা করেন একদল অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী। নেপথ্যে পরামর্শ দেন সাংসদ নজরুল ইসলাম বাবু ভাই। তিনি একজন শিক্ষা অনুরাগী মানুষ। যাকে সবাই শিক্ষাবন্ধু হিসেবে চিনেন। প্রায়ই দেখতাম, নিজ উদ্যোগে চলে আসতেন কলেজে। কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। খোঁজ-খবর নিতেন কলেজের সার্বিক বিষয়ের। তিনি নিজেও একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানেও দ্যীপম্যান আছে শিক্ষার আলো।

পড়াশোনার মানে পাঁচরুখী আনোয়ারা কলেজ সবসময়ই অন্যন্য। পাঠদানে সব শিক্ষকই আন্তরিক। কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ফকির গ্রুপের কর্ণধার আব্দুর রউফ সাহেব। তিনি এগিয়ে না আসলে ওই এলাকার ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতো। এলাকাটি শিল্প সমৃদ্ধ হলেও সব ছেলে-মেয়েদের পক্ষে সম্ভব হতো না নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা কিংবা নরসিংদী এসে পড়াশোনা করার।

একদল অভিজ্ঞ শিক্ষক জ্ঞানের আলো বিলিয়ে দিচ্ছে তরুণ শিক্ষার্থীদের মাঝে।ক্লাসের বাইরেও চলে পাঠদান। সহ-শিক্ষা কার্যক্রমেও প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে। কলেজের আঙিনাটা বৃক্ষের সমারোহ। নানা প্রজাতির গাছপালায় সমৃদ্ধ। এমন পরিবেশ যে কোনো শিক্ষার্থীদের জন্য উপভোগ্য। প্রতি বছর কলেজ থেকে আয়োজন করা হয় শিক্ষা সফরের। নিয়ে যাওয়া হয় দেশের বিভিন্ন ন্যাচারাল স্পটে। চাঁদাটাও থাকে শিক্ষার্থীর সাধ্যের মধ্যে। তাতে কোনো শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয় না শিক্ষা সফর থেকে। ভ্রমণে শিক্ষার্থীরা নিজেকে খুঁজে পায় নতুন করে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয় তারা। মিশে যায় প্রকৃতির মায়া জালে। নিজেকে নির্ভার করে। এখনো মনে পড়ে, প্রায়ই আড্ডার টেবিলে রসালো কথার ঝড় তুলে মন রাঙিয়ে দিতেন আবদুল্লাহ স্যার। আমরা হাসির ফোয়ারা বসিয়ে দিতাম। ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবের দায়িত্বটাও তাঁর ওপরই অর্পিত। রুচিবোধের ব্যাপারে খুবই সচেতন তিনি। 

করোনায় নরসিংদীতে সব ধরনের ট্রেন স্টপিজ বন্ধ ছিল। তাই সড়ক পথেই ঢাকা আসা-যাওয়া হতো আমার। বাসে চড়ার সময় জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম কলেজটির আঙিনা৷ চোখের পলকেই স্মৃতি জড়ানো কলেজটি অদৃশ্য হয়ে যায়। মায়াকান্না হয়। ভালোভাবে কেন দেখা হলো না? কতোদিন ভেবেছি কলেজটির মাটির স্পর্শ নিয়ে যাবো। আজো আসা হলো না! জীবন যুদ্ধে ছুটে চলার পথে ছুটি পাওয়াই দুঃসাধ্য। আফসোস লাগে। সময়ের ফ্রেমে এতটাই বন্দি হয়ে গেলাম!

ইচ্ছে করে আবারো ক্লাস নেই। আনন্দ উল্লাস করি। সবার সঙ্গে মিশি, গল্প করি। সবার স্নেহে বড় হই। ভেবে পাচ্ছি না কী দিয়ে যবনিকা টানব। শুনেছি, মানুষ কালোত্তীর্ণ হতে পারে না। তবে একটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তা সম্ভব। চিরন্তন সত্যকে স্মরণ করে বলতে পারি, আমি-আপনি থাকব না। যে কোনো দিন নিরালোকে চলে যেতে পারি। তবে কলেজটি তার নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে পাঁচরুখীর মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবে অনন্তকাল। এমনটাই আমার দৃঢ় প্রত্যাশা।

সোহেল রানা, সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক, পাচরুখী বেগম আনোয়ারা কলেজ, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ। 

×