
ছবি:সংগৃহীত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এক স্ট্যাটাসে বলেছেন, দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার অসীম আত্মত্যাগের ভিত্তিতে এই সরকার গঠিত হয়েছিল। সেই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত এক বছরে যেসব উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে, তা চারটি ভাগে তুলে ধরা হয়েছে: ১) আইনি সংস্কার, ২) প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও ডিজিটালাইজেশন, ৩) হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, এবং ৪) দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম।
আইনি সংস্কারে নতুন মাত্রা
গত এক বছরে আইন মন্ত্রণালয় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনের সংস্কার করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে গুমকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অভিযুক্তের অধিকার নিশ্চিত করা, বিচার সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগসহ বহু নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগে স্বতন্ত্র জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে ব্যাপক সংস্কার এনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া সহজতর করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশেও যুগোপযোগী পরিবর্তন আনা হয়েছে। এছাড়া, বিবাহ নিবন্ধন, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি এবং বাধ্যতামূলক মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা বিষয়েও উল্লেখযোগ্য আইনগত সংস্কার করা হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও প্রযুক্তি সংযোজন
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে। দেশের সব আদালতে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আদালতের কর্মচারী নিয়োগের নীতিমালা প্রস্তুত হয়েছে। অধস্তন আদালতের দুর্নীতি প্রতিরোধে সম্পদের হিসাব গ্রহণ এবং মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। বিচার কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেটদের অনলাইনে সাক্ষ্যগ্রহণ চালু হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ই-ফ্যামিলি কোর্ট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনলাইন বেইলবন্ড জমার জন্য নতুন সফটওয়্যার চালু হতে যাচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয়ের অর্ধেকের বেশি নথি ইতোমধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও জনসাধারণের স্বস্তি
জেলা কমিটি ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে গঠিত বিশেষ কমিটি ১৫,০০০টির বেশি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। সাইবার আইনের অধীনে দায়েরকৃত ৪০৮টি স্পিচ-অফেন্স মামলা এবং জুলাই-আগস্টে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ৭৫২টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ আইনি হয়রানি থেকে মুক্তি পেয়েছে।
প্রশাসনিক গতিশীলতা ও রেকর্ড সংখ্যক নিয়োগ
আইন মন্ত্রণালয়ের দৈনন্দিন কার্যক্রমে গতিশীলতা লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এক বছরে মন্ত্রীপর্যায়ে নিষ্পত্তিকৃত নথির সংখ্যা ১২৮৩টি, যা পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বিভিন্ন দপ্তরে ৩৯১টি আইনি মতামত প্রদান করা হয়েছে। সত্যায়নকৃত দলিলের সংখ্যা ১,৫৯,৫৪৪টি, যা আগের তুলনায় দ্বিগুণ। এছাড়া, আইন প্রণয়ন বিষয়ে ১২টি অংশীজন সভা আয়োজিত হয়েছে।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ফ্যাসিস্ট আমলে নিযুক্ত আইন কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে নতুন করে ৪৮৮৯ জন সরকারি আইন কর্মকর্তা এবং ২৭৪ জন অ্যাটর্নিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আপিল বিভাগে ৫ জন এবং হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ জন বিচারপতি নিয়োগে সাচিবিক সহায়তা দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের জন্যও প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে।
ড. আসিফ নজরুল এই এক বছরের মূল্যায়নে জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের আইনি অঙ্গনে এই গঠনমূলক পরিবর্তনগুলোই প্রমাণ করে যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা শুধু কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা বাস্তবায়নের পথেই রয়েছে।
মারিয়া