
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো প্রশ্নে একমত হতে পারেনি দলগুলো
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল প্রশ্নে একমত হলেও এই সরকারের কাঠামো কি হবে, সেই প্রশ্নে একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ও নির্বাচন নিয়েও মতভেদ রয়েছে।
এছাড়া মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) এবং ন্যায়পাল নিয়োগে বাছাই কমিটি গঠনের বিষয়ে আপত্তি বহাল রেখেছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। র্যাঙ্কিং পদ্ধতি নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে বিএনপি সংসদে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও জামায়াতসহ অন্যান্য দল এতে সায় দেয়নি। এই তিনটি বিষয়ে আগামীতে সিদ্ধান্ত জানাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
মঙ্গলবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২১তম দিনের আলোচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান নিয়ে আলোচনা হয়।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া। সংলাপে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষ করতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো আজকালের মধ্যে পাঠানো হবে। সেগুলো সংযুক্ত করে পরশু দিনের মধ্যে সনদের জায়গায় পৌঁছাব। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আমরা যেভাবে হোক সনদের চূড়ান্ত রূপ অন্তত পক্ষে, যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো স্পষ্ট করতে হবে এবং সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কমিশন সূত্র জানায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিয়োগের জন্য প্রস্তাবিত কাঠামো অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠিত হবে। এই কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধী দলীয় ডেপুটি স্পিকার এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি। তারা ১২ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর মধ্য থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্বাচন করবেন। তারা যদি একমত হতে না পারেন, তাহলে প্রথমে সর্বসম্মতভাবে, পরবর্তীকালে ওয়ান চয়েস ভোট এবং তারপর প্রয়োজনে র্যাঙ্ক চয়েস ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে।
এই পদ্ধতিতে ভোটার হবেন, ওপরে উল্লিখিত পাঁচজন সদস্য এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের একজন করে বিচারপতি অর্থাৎ মোট ৭ জন। তাতেও সিদ্ধান্ত না হলে র্যাঙ্কিং পদ্ধতি অনুসরণ করে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে বাছাই করা হবে। অনেকেই এতে একমত। এছাড়া ‘নারী আসন ১০০ করা’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এমন প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নীতিগতভাবে আমরা সবাই একমত। তবে গঠন পদ্ধতি নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। কমিশনসহ বিভিন্ন দলের পক্ষে একটি বাছাই কমিটির কথা হয়েছে। এখানেও সমাধান না হলে র্যাঙ্ক পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। আমরা এ জায়গায় একমত হতে পারিনি। আমরা চাই, এটি সর্বশেষ অপশন হিসেবে সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। সংসদে আলোচনা হবে। এ নিয়ে নাগরিকরা মতামত দিতে পারবেন। সভা-সেমিনার হবে। সেখানেও সমাধান না হলে আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনীর পক্ষে। তবে এক্ষেত্রে সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ থাকবে না।
তিনি বলেন, আমরা সাংবিধানিক এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ আইনের মাধ্যমে করতে চাই। এতে আইনি ত্রুটি থাকলে সংশোধন সহজ হবে। কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি সক্রিয় নির্বাহী বিভাগ প্রয়োজন। তবে সেই নির্বাহী বিভাগকে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের মধ্যে রাখতে হবে। যত বেশি কিছু সংবিধানে যুক্ত করা হবে, তত বেশি সংশোধন জটিল হয়ে পড়বে। তাই আমরা চাই আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা হোক এবং সেই আইনে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন আনা সহজ হোক।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু এখন পর্যন্ত ন্যায়পাল কোনোদিন ফাংশন করেনি, তাই আমরা প্রথমে চাই সেটি প্রতিষ্ঠিত হোক। আইন যুগোপযোগী করে, দায়িত্ব ও ক্ষমতা স্পষ্ট করে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হোক। ন্যায়পালকে শুধু তদন্তের ক্ষমতা না দিয়ে, তার প্রতিবেদনের বাস্তব প্রয়োগের জন্য আইন তৈরি করতে হবে।
নারী প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে বিএনপির অবস্থান প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা প্রথম ধাপে প্রস্তাব করেছি, আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ৫ শতাংশ অর্থাৎ ১৫টি আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে। পরবর্তী নির্বাচনে তা ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০টি হবে। আমরা চাই নারীরা সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হোক। কিন্তু সমাজের বাস্তবতা বিবেচনায় আমরা ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে চাই।
সংস্কার কমিশনের সাতশ’র বেশি সুপারিশ সম্পর্কে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা প্রায় ৬৫০টির মতো প্রস্তাবে একমত হয়েছি। বাকিগুলোর বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছি বা সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছি। সব প্রস্তাব সনদে আসবে না। তবে যেগুলো মৌলিক, যেমন সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত, সেগুলো অবশ্যই গুরুত্ব পাবে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমরা একমত হয়েছি যে জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই হতে হবে। এখানে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে প্রায় সবাই একমত, একমাত্র বিএনপি কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবে বিচারপতি দুজন যুক্ত করা হয়েছে, যেন এককভাবে তৃতীয় দল বা অন্য কেউ ডিসাইডিং ফ্যাক্টর না হয়ে যায়। আমরা আশা করি, বিচারপতিরা নিরপেক্ষ থাকবেন এবং হর্স ট্রেডিংয়ের আশঙ্কা কমবে।
এক্ষেত্রে বিএনপির বক্তব্য, যদি ঐকমত্য না হয়, তাহলে বিষয়টি সংসদে পাঠানো হোক। তবে জামায়াতসহ অধিকাংশ দল মনে করে, সংসদে পাঠালে তা আর সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে না। সংসদে ৫/৬ দল আছে, অথচ এখানে ৩০টির বেশি দলের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।
নারী আসন বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. তাহের বলেন, পিআর হলে সরাসরি নারী ১০০ আসনের পক্ষে জামায়াত। আর আগের নিয়মে হলে সংরক্ষিত ৫০ আসন ঠিক আছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে অধিকাংশ দল একমত। আর বিএনপিসহ কয়েকটি দল দ্বিমত জানিয়েছে। বিএনপি চায়, সর্বশেষ অপশন হিসেবে সংসদে সমাধান করতে হবে। আমরা এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বিএনপিকে আহ্বান জানাই। তিনি আরও বলেন, মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে না হলে জুলাই সনদে আমরা স্বাক্ষর করব না। এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। যেন পরবর্তী সরকার এর মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত না হতে পারে। ন্যায়পাল নিয়োগে কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে তিনি বলেন, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন হতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়নকারী জোনায়েদ সাকি বলেন, জুলাই সনদের এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু, উচ্চকক্ষ, পিআর পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও আমরা ঐকমত্য হতে পারিনি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি। আশা করছি, আমরা যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি, কমিশন জুলাই সনদে সেই বিষয়গুলো যুক্ত করবেন।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিগত ৪ দিন আলোচনা হলেও এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। প্রথম জায়গাটি ছিল- বাছাই কমিটি করা। বাছাই কমিটি যদি সর্বসম্মত হতে না পারলে র্যাঙ্ক চয়েস পদ্ধতি করা। সেখানে গণসংহতি আন্দোলনের নতুন প্রস্তাব, ৫ সদস্যের যে বাছাই হবে, সেখানে বিচারবিভাগ থেকে একজন প্রতিনিধি রাখা।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, বিতর্কমুক্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্র্যাকটিস করতে না পারলে গণতন্ত্র আবারও হুমকিতে পড়বে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে কমিশনের প্রস্তাবে বিচার বিভাগের সংশ্লিষ্টতা ত্রয়োদশ সংশোধনীর প্রত্যাবর্তনের প্রাথমিক ধাপ আকারে রূপ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতির প্রবর্তন হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাৎ হোসেন সেলিম বলেন, তত্ত্বাবধায়কের প্রধান উপদেষ্টা বাছায়ে ৫ সদস্যের কমিটি হয়েছে, সেই কমিটি নিয়ে আমাদের ঐকমত্য আছে। কিন্তু বাছাই কমিটি যে নাম সংগ্রহ করবে বিভিন্ন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল থেকে, সেখানে আমাদের আপত্তি হচ্ছে অনেক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নেই, আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের কোনো অবদান নেই। তাই এখানে শুধু সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল থেকে নাম সংগ্রহ করা যেতে পারে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো নিয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। আর চলমান নারী ৫০ আসনে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছি। সরাসরি নির্বাচনে নারী ১০০ আসনে নির্বাচন করা বিষয়ে অধিকাংশ দলই একমত।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, নারী ১০০ আসন ছাড়াই এবং সরাসরি নির্বাচন চাই । ইউপি বা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো তিনটা ওয়ার্ড মিলে সরাসরি নির্বাচন দেওয়া হোক।
প্যানেল হু