ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ব্যাংকের বিমাতাসুলভ আচরণ পরিবর্তনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

জটিল নিয়মের গ্যাঁড়াকলে এসএমই ঋণ, বঞ্চিত উদ্যোক্তারা

নাজমুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ১৮ মে ২০২৫

জটিল নিয়মের গ্যাঁড়াকলে এসএমই ঋণ, বঞ্চিত উদ্যোক্তারা

.

দেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এসএমই খাত। এই খাতে ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ৪৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে থাকে। সম্ভাবনাময় এই খাতকে আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা করতে পারলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে।  
অনেক উদ্যোক্তারা ঋণ জটিলতার অজুহাতে পিছিয়ে রয়েছে। এদিকে ব্যাংকগুলো এসএমই ঋণ দেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। অনেক ব্যাংক তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না।    
ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সিএমএসএমই সংজ্ঞায়নের জটিলতা, সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাব, জটিল ঋণ বিতরণ পদ্ধতি, উদ্যোক্তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকা, ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল সম্পর্ক, জামানত সংক্রান্ত সমস্যা ও এসএমই ডাটাবেজের অনুপস্থিতির কারণে ঋণ প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হচ্ছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মাঠপর্যায়ে উদ্যোক্তা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ভ্রান্ত ধারণার কারণেই ঋণ বিতরণের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এসএমই খাতকে এগিয়ে নিতে হলে তাদের অবশ্যই ব্যাংকমুখী করে সত্যিকারের উদ্যোক্তাদের ঋণ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেন, ব্যবসার জন্য ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দেয় না। ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গড়িমসি করে। এমনকি পণ্য রপ্তানিতেও ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা তারা পান না। ব্যাংকগুলোর এমন ‘বিমাতাসুলভ আচরণ’ পরিবর্তনের পরামর্শ দেন।
বিদায়ী বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে এ খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ১৩ শতাংশের বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। ব্যাংকের মোট ঋণের অন্তত ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে। আবার এই ২৫ শতাংশের অর্ধেক দিতে হবে কুটির, মাইক্রো ও ক্ষুদ্র খাতে। মোট সিএমএসএমই ঋণের মধ্যে উৎপাদনশীল শিল্পে অন্তত ৪০ শতাংশ, সেবায় ২৫ শতাংশ এবং বাকি ৩৫ শতাংশ ব্যবসা উপখাতে বিতরণ করতে হবে। নারী উদ্যোগে দিতে হবে অন্তত ১৫ শতাংশ। যদিও এ ক্ষেত্রেও উৎপাদন ও সেবার তুলনায় ব্যবসায় বেশি ঋণ দিতে আগ্রহ দেখা যায়। ব্যাংকে আমানতের বড় একটা অংশ রাখেন এসব আমানতকারী। তবে সেই টাকা নামে বেনামে কিংবা প্রভাব খাটিয়ে নিয়ে নেন বড় ব্যবসায়ীরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিদায়ী অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) এসএমই খাতে ৫৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৬২ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এই খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ৮ হাজার ২২০ কোটি টাকা। সে হিসেবে এই খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ১৩ শতাংশের বেশি।  
এ বিষয়ে নারী উদ্যোক্তা তহুরা ইতি জনকণ্ঠকে বলেন, একজন ক্ষুদ্র ও নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পক্ষে নন তিনি। ঋণ উত্তোলন ও প্রদান এক ধরনের মানসিক চাপ। মাস শেষে ঋণের চাপ থাকলে উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্র বাধাগ্রস্ত হয়। প্রথমত ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া এক ধরনের ঝামেলা। এর পর ব্যাংক কর্মকর্তারা সুদের হার ৫-৬ শতাংশ
বললেও নেওয়ার সময় ৮-৯ শতাংশ পর্যন্ত নেন যা প্রতারণা। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তরা আরও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
বড় ব্যবসায়ীদের জন্য হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত মুনাফা মওকুফ করে দেয় আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পুঁজি লুট করে হলেও ব্যাংকাররা আদায় করে নেন। এই জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।  
প্রকৃতি হ্যান্ডিক্রাফটের স্বত্বাধিকারী লিপি আক্তার জনকণ্ঠকে বলেন, প্রথম পর্যায়ে এসএমই ঋণের জন্য একজন উদ্যোক্তার অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। নতুন উদ্যোক্তার জন্য বিষয়টি অনেক চ্যালেঞ্জর। এক- দুই লাখ টাকার জন্য ব্যাংকগুলোর ঝামেলা কেউই নিতে চায় না। যে কারণে উদ্যোক্তারা ঋণ নিতে আগ্রহী নন। ঋণ নেওয়ার ৬ মাস পর যদি কিস্তি দেওয়ার নিয়ম করা যায় তাহলে অনেকেই এই সুবিধে গ্রহণ করবে।  
সায়মা সিগ্ধা নামের আরেক নারী উদ্যোক্তা বলেন, এসএমই লোনের ক্ষেত্রে মেয়ে হিসেবে যে পরিমাণে ঋণের চাহিদা দেওয়া হয় সেই পরিমাণ রাখে না ব্যাংক। এছাড়া মেয়ে হিসেবে ব্যাংক লোনের গ্যারান্টার কেউ হতে চায় না। যে কারণে অনেকে বিভ্রান্ত হন।    
এসএমই ফাউন্ডেশনের উপমহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ মোরশেদ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, উদ্যোক্তাদের জন্য এসএমই ঋণের জন্য শর্ত শিথিল প্রয়োজন। এই খাতে আরও তহবিল দেওয়া দরকার। এমএমই ঋণ ব্যাংকগুলো কাদের দিচ্ছে স্বচ্ছতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদারকি আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে তার মন্তব্য।  
এসএমই খাতের উদ্যোক্তা তৈরির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্কিল ফর ইন্ডাস্ট্রি কমপিটিটিভনেস এন্ড ইনোভেশন প্রোগ্রাম (এসআইসিআইপি) প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। এসএমই ঋণ প্রদানে যেন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় সে জন্য এই উদ্যোগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৪-৫ শতাংশ সুদের বিনিময়ে ঋণের কথা থাকলেও এনজিওদের মাধ্যমে অতিরিক্ত সুদের বিনিময়ে ঋণ দিয়ে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে।   
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরক্তি পরিচালক ও (এসআইসিআইপি) এর পিডি নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এসএমই ঋণের জন্য অনেকে প্রত্যাশা অনুয়ায়ী ঋণ পান না। তখনি উদ্যোক্তাদের মাঝে হতাশা তৈরি করে। তিনি একমত হয়ে বলেন, বড় উদ্যোক্তারা যদি এই সুবিধা পায় তাহলে এসএমই উদ্যোক্তাদের বিষয়েও এটি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।   
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্কিল ফর ইন্ডাস্ট্রি কমপিটিটিভনেস এন্ড ইনোভেশন প্রোগ্রাম (এসআইসিআইপি) প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশ কয়টি বাণিজ্যক ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের চুক্তিও হয়েছে। এই প্রোগ্রামের লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো সারা দেশের উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে কাজ করা। তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়ন করা। বিশেষ নতুন উদ্যোক্তা হতে যারা আগ্রহী তাদেরকে ব্যবসায়ী ধারণা, মার্কেটিং, ব্যবসায়ী প্রোপজাল ও ব্যাংকিং ফাইন্যান্স বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তাদের যোগ্যতাসম্পূর্ণ করে তোলা হয়। তাদের ধারণা এই সকল যোগ্য উদ্যোক্তারা নতুন ব্যবসার জন্য জেনে বুঝে ব্যাংক থেকে সঠিক পরিমাণে লোনের জন্য আবেদন করবে। ঝুঁকি এড়িয়ে নিজেকে দক্ষকর্মী হিসেবে গড়ে তুলবে।  
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকও মুখপাত্র আরিফ হাসান জানান, এসএমই ঋণের জন্য উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার সুযোগ দেখছি না। অনেক ব্যাংক লিকুইডিটি ক্রাইসিসে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই সেক্টরের জন্য রিফাইন্যান্স ফ্যাসিলিটির ব্যবস্থা করেছে। তবে করপোরেট ব্যাংকগুলোর অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো না। বড় ক্লাইন্টগুলোর ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট হয়। তবে মনে রাখবেন সিন্ডিকেট সবসময় ভালো নয়।

প্যানেল

×