ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

এক প্রার্থীর খরচই লক্ষাধিক টাকা

ভার্সিটিতে ভর্তি নিয়ে উৎকণ্ঠা

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ২২:৫০, ৭ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৭:৫৫, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪

ভার্সিটিতে ভর্তি নিয়ে উৎকণ্ঠা

.

গুচ্ছ পদ্ধতি থেকে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এবার মুখ ফিরিয়েছে। ছোট-বড় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে পৃথক ভর্তি পরীক্ষা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আবেদনের পরও পৃথক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এতে অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন ও যাতায়াতের খরচের চিন্তায় অভিভাবকদের ত্রাহি অবস্থা। অভিভাবকরা বলছেন, এত এত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে করতে পকেট ‘গড়ের মাঠ’। একই সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা ও যাতায়াত, হোটেল ভাড়াসহ নানা বিড়ম্বনা রয়েছে। খরচও বাড়বে অনেক। এর ফলে বিশ^বিদ্যালয় আবেদনে ন্যূনতম আবেদন ফি নির্ধারণে সরকারের কাছে আবেদন তাদের।
অভিভাবকরা জানান, সরকার যখন ঘোষণা করেছে, বিসিএসসহ সব ধরনের চাকরির পরীক্ষায় আবেদন ফি মাত্র ২০০ টাকা, তখন এমন হাজার হাজার টাকা ভার্সিটিতে ভর্তির আবেদনে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছ থেকে নেওয়া অনুচিত। এর ফলে যেমন অভিভাবকদের অর্থনৈতিক চাপ বাড়ছে, তেমনি শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থীদেরও ভোগান্তির শেষ নেই। এত বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্ভুল আবেদন করতেও অনেক টাকা চলে যাচ্ছে। তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করতে নাও পারে, অন্তত আবেদন ফির লাগাম টানা উচিত। এতে ৫ লাখ উচ্চ শিক্ষায় ভর্তিচ্ছু প্রার্থীর দুর্ভোগ লাঘব হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল (বিইউপি), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শাখা ও আইবিএতে ভর্তি আবেদন করেছে একাধিক শিক্ষার্থী। তাদের মধ্য থেকে এক পরীক্ষার্থীর মা নাম প্রকাশ না করে জানান, এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে আমার ৪ হাজারের বেশি টাকা ব্যয় হয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এলিজিবল বা শর্ট লিস্ট করছে। এতে টাকা জমা দিয়েও ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ বঞ্চিত হবেন বলে অনেক পরীক্ষার্থী আশঙ্কা করছেন।
রেবেকা পারভীন নামে এক অভিভাবক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ বিভাগে আবেদন ফি লেগেছে ১৫০০ টাকা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও বিইউপিতে হাজার টাকা আবেদন করতে লেগেছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক বিভাগ থাকায় আবেদনও বেশি করতে হচ্ছে। এ জন্য টাকাও লাগছে বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন জমার সংখ্যা জানতে যোগাযোগ করা হয় বিইউপির সঙ্গে। সূত্র বলছে, এ বছর ৮৭ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে এলিজিবল লিস্টে টিকেছেন ৮৭ হাজার আবেদনকারী। যারা নাম বা আবেদনে গুরুত্বপূর্ণ ভুল করেছেন, তারাই এলিজিবেল লিস্টে থাকতে পারেনি। এসব পরীক্ষার্থী ১৩টি পরীক্ষা ভ্যেনুতে পরীক্ষায় বসবেন।
বুয়েটের আবেদন প্রক্রিয়া ঘেটে দেখা যায়, বুয়েটে এবার দুই ধাপে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। একটি প্রাক্ নির্বাচনী অন্যটি মূল ভর্তি পরীক্ষা। প্রাক্ নির্বাচনী পরীক্ষা ৩ পালায় অনুষ্ঠিত হবে। এখান থেকে উত্তীর্ণ প্রার্থীরা মূল পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন। ভর্তি আবেদনের যোগ্যতায় বলা হয়েছে, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নসহ ৫ স্কেলে ন্যূনতম ৪ পয়েন্ট পেয়ে যারা মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পাস করেছেন তারা আবেদন করতে পারবেন। আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নসহ ৫ স্কেলে ৫ পয়েন্ট পেতে হবে। দুই বিভাগে শিক্ষার্র্থীরা আবেদন করতে পারবেন। এর মধ্যে একটি হলো ক ও অন্যটি খ। দুই গ্রুপের প্রাথমিক আবেদন ফি ৫০০ টাকা। এরপর পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলে প্রাক্ প্রাথমিক পরীক্ষায় অংশ নিতে নির্বাচিত প্রার্থীদের ক গ্রুপে ৮০০ ও খ গ্রুপে আরও ১০০০ টাকা ফি দিতে হবে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, আবেদনকারীদের থেকে দুই ধাপে দুই গ্রুপে বুয়েট টাকা নিচ্ছে। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবার পৃথকভাবে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করছে।
ইউজিসি সূত্র জানায়, দেশে উচ্চ শিক্ষা ভর্তিতে তিন ধাপে গুচ্ছ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে জিএসটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা (জেনারেল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি) হলো বাংলাদেশের একটি বার্ষিক সমন্বিত ভর্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ২৪টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় পরীক্ষার্থীরা। ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির জন্য ২০২১ সালে
সর্বপ্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ৩,০৫,৩৪৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন করে।
জিএসটি প্রক্রিয়ার বাইরে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষিপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হয়। গত বছর ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় সমন্বিতভাবে এই পরীক্ষায় যুক্ত হয়। কৃষিভিত্তিক গুচ্ছ পদ্ধতিতে এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে ‘প্রকৌশল গুচ্ছ’ ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়গুলোর তিনটি কুয়েট, চুয়েট ও রুয়েট সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভর্তি করে আসছিল। এবার এসব বিশ্ববিদ্যালয় ও পৃথক ভর্তির চিন্তা করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পৃথকভাবে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করবে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নতুন ও পরীক্ষা আয়োজনের সক্ষমতা নেই তারা গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে। তবে দেশে ৫৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক ভর্তি পরীক্ষা সত্যিকার অর্থে অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীদের উদ্বেগ তৈরি করেছে।
এই বিষয়ে একাধিক অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় জনকণ্ঠের। তারা জানান, সারাদেশে যে অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, এর মধ্যে অন্তত ২০টি ভার্সিটিতে পরীক্ষায় অংশ নিতে আবেদন ফি বাদব লাগছে অন্তত ২০ হাজার টাকা। এর সঙ্গে আবার যাতায়াত খরচ রয়েছে। প্রতি পরীক্ষার জন্য অন্তত ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ রয়েছে। অর্থাৎ শুধুমাত্র ভার্সিটি অ্যাডমিশন বাদব পরীক্ষা দিতেই লাখ টাকা খরচ হবে। তবে অভিভাবকদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে। কারণ মেয়ে শিক্ষার্থীদের একা একা ভর্তি পরীক্ষার জন্য অন্য জেলা বা বিভাগীয় বড় শহরে পাঠানো যায় না। এর জন্য অভিভাবকদেরও সঙ্গে যেতে হয়। আবাসন খরচ ও যাতায়াত খরচও বাড়ে। ফলে মেয়ে শিক্ষার্থীদের খরচ দ্বিগুণ। অনেক উচ্চ শিক্ষা ভর্তিচ্ছু প্রার্থী নামকরা নয় এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ারও পরিকল্পনা করছেন। এ ছাড়াও ভর্তি প্রস্তুতি হিসেবে এসব প্রার্থীর অনেকই কোচিং করতে অন্তত ২০-৩০ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ডিভিশনের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে অংশ নেয় ইউজিসি পরিচালক (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) জামিনুর রহমান। এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পরই শিক্ষা উপদেষ্টা সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আধা সরকারি পত্র দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই পত্রের কোন জবাব দেয়নি। গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্যও করতে চাননি।
জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর ১ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গুচ্ছভুক্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে উপাচার্যদের উদ্দেশে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ইতোপূর্বে আপনাকে লেখা আমার একটি চিঠিতে দেশের শিক্ষাঙ্গনে নানান অস্থিরতা বিরাজমান থাকার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু করণীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছি। আমি জানি এটা সহজ কাজ নয় এবং আপনি ও আপনার সহকর্মীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। এ প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করছি যে, বর্তমানে প্রচলিত গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসলে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে উপাচার্যরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভায় এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য একত্রিত হয়েছিলেন। দেখা গেছে যে, গুচ্ছ পরীক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে বিবিধ যুক্তি আছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে এ পদ্ধতির সংশোধন করারও সুযোগ থাকবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে থাকলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে অভিভাবক ও ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে স্মারকলিপিও পেয়েছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য গুচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতিতে ভর্তির ব্যবস্থা অনুসরণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে আপনাকে সবিনয় অনুরোধ করছি।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যায়গুলোর অবস্থান সম্পর্কে যোগাযোগ করা হয় ইউজিসির সঙ্গে। তদারকি সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, এই বিষয়ে একজন কমিশন সদস্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। পৃথক হওয়ার সুবিধা সম্পর্কে তারা জানান, পরীক্ষার্থীদের আবেদন ফি এর বড় কারণ। আবেদন থেকে যে অর্থ পরীক্ষা আয়োজনে তেমন খরচ হয় না। এটি লাভজনক বলেই বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ থেকে বাইরে থাকতে বেশি পছন্দ করে। এ ছাড়াও নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রাখতেও তা স্বতন্ত্র থাকতে চান।
সার্বিক বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এসএম এ ফায়েজ জনকণ্ঠকে বলেন, উপদেষ্টা মহোদয় যে চিঠিটি দিয়েছেন, সেটি প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এরপরও অবস্থানের পরিবর্তন নেই। এর প্রধান কারণ আইনী জটিলতা। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা আইনে পরিচালিত হয়। সেখানে হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে পরীক্ষার ফি কমানো ও বড় বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা আয়োজন করা হলে পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমবে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কথা বলবেন বলে জানান তিনি।
চেয়ারম্যান আরও বলেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে মেরিট-ডিমেরিট রয়েছে। কোনো পরীক্ষার্থী ওই দিন অসুস্থ থাকলে সে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হারাতে পারে না। তবে আবেদনের নামে বাড়তি খরচ, ভোগান্তি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়।

 

×