
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমি দুদিন আগে জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরছিলাম। হঠাৎ করে জেলে না গিয়ে আমি বঙ্গভবনে গিয়ে শপথ গ্রহণ করলাম। একেবারে উল্টো একটা অবাক চিত্র। অতীতেও এ রকম আহ্বান জানানো হয়েছিল আমাকে। সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। মাফ চেয়েছি বরাবর। এটা কোনো দিন সিরিয়াসলি ভাবিনি যে দায়িত্ব নিতে হবে। এবার ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি, এ জন্য দায়িত্বও নিয়েছি।
নতুন বাংলাদেশ নিয়ে মানুষের স্বপ্ন, গুরুত্বপূর্ণ নানা খাতে সংস্কারের মাধ্যমে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন, গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং চলমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, ‘একটা নতুন দায়িত্ব। বড় দায়িত্ব। দায়িত্ব সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। হঠাৎ করে যে একটা দায়িত্ব এল, সেটা বহন করার মতো যোগ্যতা অর্জন করা, সেটাকে কাজে পরিণত করতে সচেষ্ট আছি।’
এই বিরাট পরিবর্তন ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, ‘ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। পত্রিকায় টেলিভিশনের নিউজে তাঁদের দেখছিলাম। বরাবর যেভাবে আন্দোলন হয়, এভাবেই দেখছিলাম। আমি তখন বিদেশে ছিলাম যখন এই আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছিল। আমি পরিকল্পনা করছিলাম বার্লিনে যাব, বার্লিনের পর রোমে যাব। তারপর ব্রাজিল যাব ইত্যাদি। দেশে ফিরে আসব এবং এ রকম একটা দায়িত্ব নিতে হবে, এটা একদম মাথায় ছিল না। এ সময় ছাত্রদের একজন আমার অফিসকে জানাল যে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়। ছাত্রদের কথা এই প্রথম শুনলাম। জানতে চাইলাম, কী আলাপ করতে চায়। তখন আমাকে জানানো হলো, আপনাকে সরকারের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি বললাম, এটা তো ভিন্ন কথা। তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে? সে জানাল, আলাপ হয়েছে। আমি বললাম, ঠিক আছে আমিও আলাপ করি, কী বলে দেখি। সে যোগাযোগ করিয়ে দিল, আমি আলাপ করলাম। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়ো না। বরাবরই আমি এই দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থেকেছি। এই দায়িত্ব নেওয়া ঠিক হবে না। তোমরা অন্য একজনকে ভালো করে খুঁজে দেখো। তারা বলল, না স্যার আর কেউ নেই। আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাদের আবার বললাম, তোমরা খোঁজ করো। খোঁজ করার পর আমাকে বলো, কী দাঁড়াল। তখন সে আমাকে জানাল, ঠিক আছে স্যার, কাল আপনাকে জানাব। পরদিন আবার সে ফোন করল। সে জানাল, স্যার, উপায় নেই। আপনাকেই আসতে হবে। আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
ছাত্রনেতারা ছাড়া বাইরের আর কারো সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ হয়েছিল কিনা- প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আর কে যে আছে, তা–ও তো আমি জানি না। আমার কিছু জানা ছিল না। ছাত্রনেতাদের কারো সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। তারা কারা, ঢাকায় এসে তাদের চেহারা আমি দেখেছি। তাদের সঙ্গে কথা হলো। এয়ারপোর্টে তারা ছিল। তখন তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো।’
দেশের একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘একেবারে দ্রুতগতিতে সবকিছু ঘটেছে। আমি ফিরে এলাম। সেদিন রাতেই শপথ গ্রহণ করলাম। সব ওলট–পালট। দেশে ফিরে এসে কোথায় জেলে যাব, এখন অন্য দিকে চলে গেলাম! কী করতে হবে? এরা কারা? শপথ গ্রহণে কারা কারা থাকবে? সবকিছুই নতুন! সবকিছু ভিন্ন পরিস্থিতি। তবু মনে করলাম দায়িত্ব যখন তারা নিতে বলেছে, আমি রাজি হয়েছি, কাজেই আমি সে দায়িত্ব পালন করব। এভাবেই একটা অপরিচিত জগতের মধ্যে অপরিচিত সঙ্গী নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলো।’
সংস্কারের যে উদ্যোগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের জোর ছিল সংস্কারে। আমাদের যদি সংস্কার করতে হয়, দ্রুতগতিতে করতে হবে। ধীরে–সুস্থে সংস্কার করার সুযোগ আমাদের নেই। কাজেই সেই সংস্কারগুলো আমাদের এখন থেকে শুরু করতে হবে। একটা বিধ্বস্ত কাঠামোর ওপর আমরা শুরু করেছি।’
সরকারে এসে আপনি কি দেখলেন জানতে চাইলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘ভাঙা হাট। কোনো জিনিস ফাংশন করে না। একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্ট্রাকচার আছে, এক ব্যক্তিপূজার জন্য যা যা লাগে, সে ব্যবস্থাগুলো আছে। ওনার হুকুমে কী কী হয়, ওনার ইচ্ছাপূরণের জন্য সব ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের ইচ্ছাপূরণের জন্য তাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। কাজেই এ রকম একটা ভাঙাচোরা জনপ্রশাসন নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।’
পুলিশ বাহিনী ভেঙে পড়েছে, এখন মানুষকে আশ্বস্ত করবেন কী দিয়ে- এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওপর থেকে তো সব সহযোগিতা আছে। কিন্তু গুঞ্জন শুনি, এখানে গোপনে বসে আছে। আমরা এগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। এগুলো শুনলে কিন্তু কোনো কাজ করা যাবে না। যেভাবে আছে, সেভাবেই আমরা চলছি। যেহেতু পুলিশের পুরোপুরি সার্ভিসটা আমরা পাচ্ছিলাম না, সে জন্য আমরা সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন এগিয়ে আসে। তারা এগিয়ে এল। তারপর বলল, আমাদের তো কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার প্রসঙ্গটি উঠল। আমরাও রাজি হলাম। প্রাথমিকভাবে তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দুই মাসের জন্য দিলাম। যাতে করে তারা মাঠে নামতে পারে।’
কাজের যা অগ্রগতি এবং তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট- প্রশ্নে সরকারপ্রধান বলেন, ‘এটা নির্ভর করে আপনি কি এক্সপেক্ট করেন। সরকার একটা মহা–ইঞ্জিন। এই মহা–ইঞ্জিন আমরা চালু করার চেষ্টা করছি। প্রথমে আমরা ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে চেষ্টা করছি, চালানো যায় কি না। এটা নড়লে আমরা সেকেন্ড গিয়ার, থার্ড গিয়ারের দিকে যাব। এটা হলো বিষয়। আমরা এক ধাপে থার্ড গিয়ারে চলে গেলাম, ফুল স্পিডে চলে গেলাম, এটা সম্ভব না। কাজেই ওই গতিটা আমাদের অ্যাডজাস্ট করতে হবে। তারপর যেন পুরো স্পিডে যেতে পারি। এটা কিন্তু বেশি সময় দিলে তা–ও হচ্ছে না। আমাদের তো কাজের মধ্যে নামতে হবে। কাজ তো অনেক, অফুরন্ত কাজ আছে।’
নতুন কোনো সদস্য উপদেষ্টা পরিষদে যোগ করবেন কিনা- প্রশ্নে ড. ইউনূস বলেন, ‘কমিশনটা আমি অন্যভাবে দেখছি। যন্ত্রটা চালু করার জন্য মাঝেমধ্যে আলাপ হয়েছে যে আরও কয়েকজন সদস্য নিলে ভালো হয়। এ ব্যাপারে পাকা কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বিষয়টা খোলা আছে। এ অবস্থাতেই আমরা আছি। তবে আমরা উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্যসংখ্যা খুব একটা বাড়াতেও চাই না। এতেও একটা বড় রকমের সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমরা খুব ছোট আকারে যেতে চাইছি।’
এখন চারপাশে যা দেখেন, এতে কি আপনি আশাবাদী এবং রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে নিয়ে কমিশনের উদ্যোগে আপনারা কত দূর পর্যন্ত করে যেতে পারবেন- প্রশ্নে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি এক শ ভাগ আশাবাদী। কারণ, সবাই সংস্কার চায়। মুখে যে যা–ই বলুক না কেন, ভেতরে সবাই সংস্কার চায়। এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আপনি পার পেয়ে যাবেন, আপনার ছেলেমেয়ে আটকে যাবে। এই গর্তের মধ্যে আবার পড়তে হবে। যেই গর্ত থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। যেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা বের হয়ে এলাম, সেই ধ্বংসস্তূপ আবার সৃষ্টি হবে। কাজেই সংশোধনের দায়িত্ব আপনাদের, আমরা শুধু ফেসিলিটেট করে যাচ্ছি।’
এম হাসান