ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি

আমার কাঁধে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাব

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:২০, ১২ আগস্ট ২০২৪

আমার কাঁধে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাব

সৈয়দ রেফাত আহমেদ

নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহাজাগরণ  ঘটিয়েছেন। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ফলে আমার কাঁধে যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা আমি পালন করে যাব। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে বলে জানান তিনি।

সোমবার আপিল বিভাগে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট বারের পক্ষ থেকে সংবর্ধনার জবাবে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের সকল বিচারপতি, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, আপনার নিয়োগের পেছনে রয়েছে রক্তে ভেজা ইতিহাস। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের বার সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, মামলা পরিচালনার দীর্ঘসূত্রতা দূর করবেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। সমাজের সব বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবেন।

বক্তব্যের শুরুতেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহতদের স্মরণ করে বলেন, সারাদেশের ছাত্র-জনতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। যারা এই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছিলেন তাদেরও অভিনন্দন জানাচ্ছি। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহাজাগরণের উন্মেষ ঘটিয়েছেন। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের ফলে আমার কাঁধে যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা আমি পালন করে যাব। এই মুহূর্তে আমরা ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে নতুন করে শুরু করতে হবে। এতদিন ন্যায়বিচারের পরিবর্তে নিপীড়নের নীতি প্রচলিত ছিল।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, ইতিহাসের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে আমাদের পূর্বপুরুষরা সব সময় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অধিকারের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছেন। সেইসব ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামের সাম্প্রতিক সংগ্রামটি হলো ২০২৪ সালের সংঘটিত আমাদের এই গণঅভ্যুত্থান। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, আমাদের বীর ছাত্র-জনতা ইতিহাসের এক মহাক্রান্তিকালের অনিবার্য আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক মহাজাগরণের উন্মেষ ঘটিয়েছেন। 
সাভার স্মৃতিসৌধে ॥ এর আগে সোমবার সকাল ৭টায় সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। পরে সাভার থেকে সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে জাতীয় শহীদ মিনারে পৌঁছান।

এরপর পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। একইসঙ্গে জাতীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের প্রতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান বিচারপতি। শ্রদ্ধা নিবেদনকালে অন্যদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ছাড়াও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ, সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্টার ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রক্তে ভেজা ইতিহাস ॥ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে উদ্দেশ করে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছে, দ্বিতীয় মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত এক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি আপনি। আপনাকে  রাষ্ট্রপতিই শুধু পছন্দ করে নিয়োগ প্রদান করেননি, আপনার নিয়োগের পেছনে রয়েছে এ দেশের শত শত নিরীহ ছাত্রের বুকের রক্ত।
তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে এ ঘটনা বিরল। বিপ্লবোত্তর যে কোনো দেশে রাজপথ কিংবা রণাঙ্গন ঠিক করে দেয় সে দেশের নেতা কে হবে। আর আমাদের দেশের বীর ছাত্ররা, তাদের পাশে থাকা অভিভাবকরা, তাদের শুভাকাক্সক্ষীরা রাজপথ থেকে আপনাকে প্রধান বিচারপতি করার দাবি তুলেছিল। এ ভালোবাসা বিরল, এ ভালোবাসা অমূল্য, এ ভালোবাসা নিয়ে গর্ব করতেই পারি, তাই না? 
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গুম হওয়া মানুষের আত্মা, অসংখ্য মানুষের বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার বেদনা, অগণিত মানুষের নির্যাতন-নীপিড়নের গল্প, অনেক মৃত মানুষের গায়েবি মামলায় আসামি হওয়ার অভিশাপ, অনেক পরিবারের নিঃস্ব হওয়ার হাহাকার থেকে উচ্চারিত প্রতিবাদের ভাষা থেকে প্রতিরোধে রূপ নেওয়ার অন্য অবয়ব আজকের বাংলাদেশ।

সেই বাংলাদেশে খুন-গুম-নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার সেইসব আত্মা, সেইসব মানুষ আজ ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষায় আছে, আপনার দিকে তাকিয়ে আছে, গোটা দেশবাসীর মতো আমিও আশা করি আপনি তাদের বিমুখ করবেন না। 
প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বিচার বিভাগ চাই ॥ প্রভাবমুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করতে প্রধান বিচারপতির কাছে আহ্বান করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। সোমবার আপিল বিভাগের এক নম্বর এজলাস কক্ষে রেওয়াজ অনুযায়ী নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেওয়া সংবর্ধনায় এমন মন্তব্য করেন তিনি।

এ সময় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেন, বিগত দিনে বিচার বিভাগকে ক্রমান্বয়ে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে নির্বাহী বিভাগের আজ্ঞাবহ করে রাখার মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
আমরা দেখেছি কীভাবে দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ছাত্র জনতার যৌক্তিক ও অরাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বিচার বিভাগকে জনরোষের মধ্যে ফেলে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আর এ ধরনের ন্যক্কারজনক অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি আশা করি না।

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশে করে ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, শত শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা রক্ষায় এবং আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বিচার বিভাগের প্রতি নতুন প্রজন্ম এবং বাংলাদেশের গণমানুষের যে আশা আকাক্সক্ষা তার প্রতিফলন ঘটানো অত্যাবশ্যক।

আপনি বিচার বিভাগের প্রভাবমুক্ত সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করবেন। নাগরিকের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। মামলা পরিচালনার দীর্ঘসূত্রতা দূর করবেন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। সমাজের সব বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবেন।

×