ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ১৩ জুন ২০২৪

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

পবিত্র  মক্কা নগরী অসংখ্য মসজিদ ও আজানের শহর, নানা হোটেল ও অপরূপ মার্কেটের শহর, সুউচ্চ এবং দৃষ্টিকাড়া ইমারত আর চারপাশে লাখ লাখ কবুতরের বাক্বাকুম আওয়াজ ও গুনগুনানির শহর। এ নগরকে হাজি, ওমরাহকারী ও দর্শনার্থীদের জন্য আরাম-আয়েশসম্পন্ন, নিরাপদ করার স্বার্থে বিশ্বের অন্যতম সেরা ধনী দেশটির নানা কোশেশের অন্ত নেই।

এজন্য প্রতিবছর বিরামহীন চলছে নগরীতে নির্মাণ কাজ। কোনো সুরম্য ভবন একটু প্রশ্নের সম্মুখীন হলেই নির্দয়ভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এদিক দিয়ে মক্কা শহরকে ভাঙা-গড়ার শহরও বলা যায়। এতসব আয়োজন সত্ত্বেও প্রচুর  অপচয় ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাহীনতার বিষয়টি চিন্তাশীল মহলে এড়িয়ে যায় না। একেবারেই মসজিদুল হারামের পাশেই যেসব সুউচ্চ ইমারত শোভা পাচ্ছে, তা বাণিজ্যিক চিন্তা ও বাহ্যিক সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই না।

বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়াতে গিয়ে হারামের প্রশস্ততা ও প্রাকৃতিক অপরূপ মহিমাময় দৃশ্যকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে, একই সঙ্গে ক্ষুণœ হচ্ছে ইবাদতের একাগ্রতা ও আধ্যাত্মিক আমেজ। হারাম শরীফের পাশেই আছে যেমন দার আত তাওহিদ হোটেল, মহান খলিফাতুর রাসূল হযরত আবু বকরের (রা) বাড়ি ভেঙে নির্মিত সুরম্য আবাসিক হোটেল ও মার্কেট মক্কা টাওয়ার, অগুনতি নবী, রাসূলের স্মৃতিধন্য জাবালে আবু কুবাইসে তৈরি হওয়া রাজকীয় অতিথি ভবন।

সবশেষে তুর্কি স্থাপনার ওপর নির্মিত হয়েছে বিশালকায় বেশ কয়েকটি মার্কেট ও আবাসিক হোটেলের সমাহার আবরাজ আল বাইত। এ আবরাজ আল বাইত নিয়ে আজ একটু আলোচনা করব।
পবিত্র কা’বা ঘরের দক্ষিণ প্রবেশপথ সংলগ্ন এলাকায় বর্তমানে অবস্থিত মক্কা রয়েল টাওয়ার বা আবরাজ আল বাইত পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয়  স্থাপনা।

৭৬তলা বিশিষ্ট এক হাজার ৯৭২ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন এ টাওয়ারের একেবারে শীর্ষে গড়ে তোলা হয়েছে ১৩০ ফুট রাজকীয় ঘড়ি যা ১৭ কিলোমিটার দূর থেকে সময় দেখা যায়। চন্দ্র পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র, মুসলিম ঐতিহ্য সংরক্ষণে জাদুঘর এবং হজ ও ওমরাহ পালনকারী পুণ্যার্থীদের জন্য তিন হাজার অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত কক্ষ এ টাওয়ারের বৈশিষ্ট্য।

সৌদি আরবের খ্যাতনামা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বিন লাদেন গ্রুপ ২০০৪ সালে এ টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শুরু করে। ফ্লোরের সর্বমোট স্পেস হচ্ছে এক কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার বর্গফুট যা আরব আমিরাতের দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৩ নম্বর টার্মিনালের সমান। ৮০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মীয়মাণ এ টাওয়ারে ১০ হাজার মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে সক্ষম এমন বিশাল প্রার্থনা হল রয়েছে।

টাওয়ারের সেভেন স্টার হোটেল প্রতিবছর পবিত্র হজ ও ওমরাহ পালন উপলক্ষে মক্কা নগরী পরিভ্রমণকারী ৫০ লাখ পুণ্যার্থীর আবাসন সুবিধা প্রদান করে। আবরাজ আল বাইত টাওয়ারে প্রথম চারতলা শপিংমল এবং নিচে রয়েছে এক হাজার গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা। টাওয়ারের একেবারে উপরের তলায় দুটি হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য রয়েছে প্রশস্ত হেলিপ্যাড।

এক লাখ মানুষের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন এ টাওয়ারের শীর্ষে চারদিক দিয়ে দেখা যায় এমন একটি ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছে। জার্মানির প্রিমিয়ার কম্পোজিট টেকনোলজিস কোম্পানি  এর ডিজাইন করে। লন্ডনের ওয়েস্ট মিনস্টার ও ইস্তানবুলের কেভাহির মল টাওয়ার ঘড়ির চেয়েও মক্কা টাওয়ার ঘড়ির আয়তন ও নান্দনিকতা বেশি।

ঘড়ির চারপাশ আলোকিত করার জন্য ২০ লাখ এলইডি বাতি, বিপুল সংখ্যক আল্লাহু আকবর লিখিত ক্যালিওগ্রাফি সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ২১ হাজার সাদা ও সবুজ বাতি ঘড়ির উপরাংশে স্থাপন করা হয়েছে, যাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় ফ্ল্যাশ সংকেত দিতে পারে। আকাশের দিকের ১০ কিমি পর্যন্ত আলোকরশ্মি প্রক্ষেপণের জন্য ১৬ ধরনের ভার্টিক্যাল বাতি রয়েছে।

ঘড়ির চারপাশের সম্মুখ অংশে ১০০ কোটি খ- গ্লাস মোজাইক বসানো হয়েছে। ঘড়ির উপর রয়েছে ৯৩ মিটার দৈর্ঘ্য অগ্রচূড়া এবং স্বর্ণালি মোজাইক ও ফাইবার গ্লাসের তৈরি ৩৫ টন ওজনের নতুন চাঁদ। টাওয়ারের নিচ থেকে উপরে বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বহু লাউডস্পিকার স্থাপন করা হয়েছে, যা সাত কিমি দূর পর্যন্ত আজান ও নামাজের ধ্বনি প্রচার করতে পারে।

রাতেরবেলা ২১ হাজার বাতি ৩০ কিমি এলাকাকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলবে। শ্বেত ও সবুজ বাতির বিশেষ আলো প্রক্ষেপণ দেখে বধির হাজিরা নামাজের সময় নির্ণয় করতে সক্ষম হবেন। মক্কা টাওয়ারে ঘড়ি স্থাপনের পেছনে আরও অনেক কারণ ক্রিয়াশীল। ১২৬ বছরের পুরানো গ্রিনিচমান (সময়) পরির্বতন করে মক্কার সময় চালু করা যাবে বলে অনেকের ধারণা।

২০০৮ সালে কাতারের রাজধানী দোহাতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে মুসলিম বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেন যে, পৃথিবীর মধ্যমরেখা পবিত্র মক্কার ওপর দিয়ে প্রলম্বিত, ফলে মক্কা পৃথিবীর টাইম জোনের কেন্দ্রবিন্দু। এছাড়া মক্কা আন্তর্জাতিক ধর্মীয় ও বাণিজ্য নগরী। 
সুতরাং পবিত্র মক্কা শরীফ ও মদিনা শরীফ হজ ও জিয়ারতের পুণ্যভূমি তো বটেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আধুনিক যুগে এ স্থানগুলো গভীর অনুভব আর আত্মতৃপ্তিরও।

×