ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

জাতীয় বিমা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

ভবনটিতে জরুরি নির্গমন পথ না থাকায় ক্ষোভ

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ১ মার্চ ২০২৪

ভবনটিতে জরুরি নির্গমন পথ না  থাকায় ক্ষোভ

প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে শ্রেষ্ঠ জীবন বিমা প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার নিলেন ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর বেইলি রোডে আগুন লাগা বহুতল ভবনটির নির্মাণ ত্রুটির কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, যে আগুনটা লাগল তা একটা বহুতল ভবনে। অথচ সেখানে কোনো ফায়ার এক্সিট (বহির্গমন পথ) ছিল না। ৪৬ জন মারা গেছেন, এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? অথচ ফায়ার এক্সটিংগুইশার লাগানো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে বারবার আমরা নির্দেশ দিচ্ছি। সেটা কিন্তু আর মানা হচ্ছে না। আর আমি জানি এখানে নিশ্চয়ই ইন্স্যুরেন্স নেই, কাজেই তারা কিছু পাবেও না। এসব ক্ষেত্রে সচেতনতা খুব বেশি প্রয়োজন।

শুক্রবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রেজাতীয় বিমা দিবস-২০২৪উদ্্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী নিয়ম মেনে ভবন নির্মাণের তাগিদ দিয়ে বলেন, সবসময় আর্কিটেক্টদের অনুরোধ করি, আপনারা যখন ঘরবাড়ি তৈরি করেন, একটু খোলা বারান্দা, ফায়ার এক্সিট বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করবেন। যারা (ভবন) তৈরি করতে চায়, সেই মালিকরাও এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে চায় না, তাই আর্কিটেক্টরাও ওরকম ডিজাইন ঠিকমতো করে না।

অনুষ্ঠানে ব্যাংকের মাধ্যমে বিমা, অর্থাৎ ব্যাংকের গ্রাহকরা প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংক থেকেই বিমা পলিসি যাতে নিতে পারেন সেজন্য প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানেব্যাংকাস্যুরেন্সএর  উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে জাতীয় বিমা দিবস-২০২৪ উপলক্ষে বিমা দাবি পরিশোধের ভিত্তিতে চারটি প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন। তিনি দিবসটি উপলক্ষে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যেও পুরস্কার বিতরণ করেন।

অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। স্বাগত বক্তৃতা করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ। বিমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেনও বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বিমা শিল্পের ওপর এবংব্যাংকাস্যুরেন্সএর ওপর নির্মিত পৃথক দুটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়।

উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬০ সালের মার্চ পাকিস্তানের আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অঞ্চলের প্রধান হিসেবে যোগ দেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে সে সময় বঙ্গবন্ধু এখান থেকেই দেশব্যাপী সংগঠন গোছানোর সুযোগ পান এবং বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফাও এখানে বসেই প্রণয়ন করেন। তাঁর যোগদানের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের বিমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সুপারিশক্রমে প্রতি বছর মার্চকে জাতীয় বিমা দিবস ঘোষণা করে সরকার। এটি এখনতালিকাভুক্ত দিবস হিসেবে সারাদেশে উদ্যাপিত হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উদ্যোগে উদ্যাপিত দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘করব বিমা গড়ব দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ

সরকারপ্রধান বলেন, আমি নিজে প্রত্যক্ষদর্শী এবং দেখেছি, অনেক সময় বিমা নিয়ে অনেকেই নানা ধরনের ব্যবসাও করে। হয়তো কোথাও একটু দেখাল আগুন লেগেছে। ক্ষতির পরিমাণ যত না, তার চেয়ে অনেক বেশি দাবি করে বসে। শুধু দাবি করা নয়, যারা যায় পরীক্ষা করতে তাদেরও ম্যানেজ করে ফেলে। ফলে বিরাট অঙ্কের টাকা বেরিয়ে যায়। এই রকম দুই-একটা কেস আমি নিজে ধরেছি।

অগ্নিকাণ্ডের একটি ঘটনা তদন্তের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এলো। আমি কথাটি এজন্য বলছি। আপনাদেরও সচেতন থাকা দরকার। একটি গার্মেন্টস কারখানা, প্রায়ই আগুন লাগত গার্মেন্টসে। ঘন ঘন আগুন লাগে। আমি বললাম বিষয়টা কী, এত ঘন ঘন আগুন লাগে কেন? আগুন লাগার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। তদন্তে বের হয়ে এলো, ওই গার্মেন্টসের এক কর্মীকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে নাস্তাপানি খাওয়ার জায়গায় আগুন দিয়ে ৪০ কোটি টাকা দাবি করল। 

তিনি বলেন, এখন তো আমাদের ফরেনসিক বিভাগে বিভিন্ন পরীক্ষার সুযোগ আছে। কী কী জিনিস পুড়েছে, তা পরীক্ষা করতে বললাম। সব পরীক্ষা করা হলো। দেখা গেল কিছু রাবিশ রেখে সেখানে আগুন দেওয়া হয়েছিল। তারপরে ৪০ কোটি টাকা দাবি ওঠে। ৪০ কোটি টাকার সম্পদ তো এখানে পুড়ে যায়নি। তাহলে এত টাকা কেন দাবি করবে?

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, খুব ঘন ঘন আগুন লাগত। আমি নাম বলব না। কিন্তু আমি জানি। অনেকেই হয়তো বুঝতেই পারবেন। ঘন ঘন আগুন লাগত, সেজন্য আমি ধরলাম বিষয়টা। কিছু তথ্য পেলাম। সেখানে নিজেরাই আগুন দিত। মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নেওয়া হতো। আপনারা যারা বিমার সঙ্গে জড়িত, অবশ্যই বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবেন। এই ধরনের ঘটনা যেন কেউ ঘটাতে না পারে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যাতে আরও বিমার দিকে এগিয়ে আসে, সে বিষয়ে আপনারা যত্নবান হবেন। আর বিমা দাবিগুলো যাতে মানুষ সহজে পায়, যারা দুই নম্বরি করবে তাদের কথা বলছি না, প্রকৃতপক্ষে যারা পায়, তাদেরটা যেন সহজে পেতে পারে। এদিকে একটু দৃষ্টি দিতে হবে। যারা দুই নম্বরি করে, তারা আবার পেয়ে যায়। কারণ তারা ম্যানেজ করে ফেলে। কেউ যেন ম্যানেজ করতে না পারে, সত্যিকারে যারা প্রাপ্য তারা যেন সঠিকভাবে অল্প সময়ের মধ্যে পেতে পারে, সেটাও ব্যাংকের মাধ্যমে করে দেওয়া যেতে পারে, এখন তো সুবিধা হয়ে গেছে।

৭১- মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশ বিশে^ যে মর্যাদা পেয়েছিল এবং৭৫- জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর যা হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর সরকার আবার তা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী  বলেন, ২০০৯ সালে নির্বাচনে বিজয়ের পর টানা তিন মেয়াদে দেশ পরিচালনার পর চতুর্থ মেয়াদেও নির্বাচিত হওয়ায় দেশের উন্নয়নে সব থেকে বড় সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সরকার পরিচালনার সুযোগ পাওয়ায় আজকে উন্নয়নের ছোঁয়াটা সাধারণ মানুষের কাছে আমরা পৌঁছাতে পেরেছি।

তিনি বলেন, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বছর বছর দেশের কিছু অঞ্চলে যে মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষ হতো, সেটা আর নেই এবং মানুষের জীবনমানও অনেক উন্নত হয়েছে।৯৬ সালে প্রথমবার সরকারে আসার পরেই বেসরকারি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে তা তিনি উন্মুক্ত করে দেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার চায় দেশ আরও এগিয়ে যাক। এজন্য আমরা ব্যাংক, বিমা, বিদ্যুৎসহ সমস্ত কিছুই বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। সেক্ষেত্রেও আমি মনে করি ইন্স্যুরেন্স করার ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে আরও সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। সে বিষয়ে আপনারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন, সেটাই চাই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের লক্ষ্য দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তারপরেও দুর্ঘটনা, দুর্বিপাক যে কোনো সময় ঘটতে পারে। তা ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ আমাদের। সেক্ষেত্রে মানুষকে একটু সঞ্চয়মুখী করা, মানুষকে আরও উদ্বুদ্ধ করা, উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়াটা জরুরি। আর সেক্ষেত্রে ইন্স্যুরেন্স কিন্তু মানুষকে নিরাপদ জীবন দিতে পারে। কোনো দুর্ঘটনা বা অসুখ-বিসুখ বিষয়ে ইন্স্যুরেন্স করা থাকলে পরে মানুষ অন্তত নিশ্চিত থাকতে পারে। সে বিষয়টা সম্পর্কে মানুষকে আরও জানানো দরকার।

সরকারপ্রধান বলেন, মানুষ যাতে বিমা গ্রহণ করতে পারে সেইদিকে বিমা সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে। আর বিমা সহজিকরণের লক্ষ্যে আজ যেব্যাংকাস্যুরেন্সচালু করা হলো এজন্য সংশ্লিষ্টদের তিনি ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, তাঁর সরকার বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর একের পর এক যখন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদান করছিল তখন অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা (উন্নয়ন সহযোগী) প্রশ্ন তুলেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি এত ছোট এতগুলো ব্যাংক দিয়ে কি হবে? আমার উত্তর ছিল আমাদের অর্থনীতি এত ছোট থাকবে না, অবশ্যই বড় হবে। সেই বড় তো আমরা করতে পেরেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমাদের ব্যাংকগুলো উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত শাখা খুলছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো কাজ করছে। সেই সঙ্গে এই বিমাগুলো যখন যুক্ত হবে এবং বিমার প্রিমিয়াম দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু ব্যাংকের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে, অনলাইনে যখন সম্পন্ন করা যাবে তখন কিন্তু মানুষের আর ওই দ্বিধা থাকবে না। ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রিমিয়াম জমা হবে। এজন্য আলাদা স্মরণ করে জমাও দিতে হবে না, তামাদিও হবে না। কাজেই তাতে ইন্স্যুরেন্সেরও লাভ হবে ব্যাংকেরও সুবিধা হবে। ব্যাংকের কার্যক্রমও বাড়বে।

বিমা খাতের উন্নয়নেঅ্যাকচুয়ারিসৃষ্টিতে বৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, বিমা খাতেইউনিফায়েড ম্যাসেজিং প্লাটফর্মবাস্তবায়নসহ খাতের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যেবাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টবাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিমা খাতে পেশাদারিত্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আরও বেশি বৃদ্ধি পাবে বলে আমি বিশ^াস করি।

অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিনে শুরুতেই তিনি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহারা দুই লাখ মা-বোন এবং জাতীয় চারনেতাসহ৭৫ এর ১৫ আগস্টের শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এই মাসেই (১৭ মার্চ) জাতির পিতা জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। যা আজ বিশ^ ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলে মানুষকে উজ্জীবিতকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।

×