.
১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম আবারও তেলের সন্ধান পাওয়া গেল। সিলেট ১০ নম্বর গ্যাস কূপে পাওয়া গেছে এই তেল। এই কূপের চারটি স্তরের প্রথম স্তরে তেলের পাশাপাশি পাওয়া গেছে গ্যাসের সন্ধানও। গত ৮ ডিসেম্বর পরীক্ষা করে এখানে তেলের উপস্থিতির কথা জানতে পারেন কূপসংশ্লিষ্টরা। যার প্রাথমিক এপিআই গ্র্যাভিটি (তেলের মান) হলো ২৯ দশমিক ৭। প্রথম দিনের দুই ঘণ্টায় ৭০ ব্যারেলের মতো তেল উঠেছে এখান থেকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সব ঠিকঠাক থাকলে ধারণা করা হচ্ছে এখানে মজুত থাকতে পারে ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল। এখান থেকে দৈনিক অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ ব্যারেল তেল পাওয়া যেতে পারে।
পেট্রোবাংলা বলছে, ৫৬ টাকা লিটার হিসেবে এর মূল্য হবে অন্তত ৭ হাজার কোটি টাকা। প্রাপ্ত তেল পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) ও সিলেট গ্যাস ক্ষেত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। চূড়ান্ত ফলের ভিত্তিতেই জানা যাবে এর প্রকৃত মূল্য এবং মজুত। একই কূপের অন্য তিন স্তরে পাওয়া গেছে ৪৩ থেকে ১০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধানও। যা দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়াকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলা বলছে, সিলেট ১০ নম্বর কূপটি সম্প্রতি দুই হাজার ৫৭৬ মিটার গভীরতায় খনন কাজ সম্পন্ন করা হয়। এতে চার স্তরে গ্যাসের পাশাপাশি তেলের সন্ধানও পাওয়া যায়। এর নিচের স্তরটি দুই হাজার ৫৪০ মিটার টেস্ট করে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রবাহ পাওয়া যায় এবং ফ্লোয়িং প্রেসার তিন হাজার ২৫০ পিএসআই। মজুতের পরিমাণ ৪৩ থেকে ১০০ বিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত। এছাড়া দুই হাজার ৪৬০ থেকে দুই হাজার ৪৭৫ মিটারে আরও একটি ভালো গ্যাস স্তর পাওয়া যায়। এখানে টেস্ট করলে ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আশা করছে পেট্রোবাংলা। একই কূপে দুই হাজার ২৯০ থেকে দুই হাজার ৩২০ মিটারেও গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। একহাজার ৩৯৭ থেকে একহাজার ৪৪৫ মিটার গভীরতায় আরও একটি জোন পাওয়া যায়। যেখানে গত ৮ তারিখে পরীক্ষা করে তেলের উপস্থিতি জানা যায়। যার প্রাথমিকভাবে এপিআই প্রাভিটি ২৯.৭ ডিগ্রি। সেলফ প্রেসারে প্রতি ঘণ্টায় এখানে ৩৫ ব্যারেল তেলের প্রবাহ পাওয়া যায়।
পরীক্ষা সম্পন্ন হলে এখানে তেলের মজুত সম্পর্কে জানা যাবে জানিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, একই প্রেসারে এখানে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ ব্যারেল তেলের প্রবাহ পাওয়া যাচ্ছে। গ্যাসের বদলে এখানে এখন তেলই উঠছে। এই মুহূর্তে যে প্রেসার আছে, তাতে ড্রিল করার সময় ৩৫ ব্যারেল তেল উঠছে। পরীক্ষা শেষ হলে তেলের মজুত জানা যাবে। এজন্য চার থেকে পাঁচ মাস সময় অপেক্ষা করতে হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এর আগে ১৯৮৬ সালে হরিপুরে তেলের অস্তিত্ব পেয়েছিলাম। সেটি পাঁচ বছর টিকে ছিল। কিন্তু সেটির এপিআই গ্র্যাভিটি ছিল ২৭। এবার যে তেলের মজুত পাচ্ছি, যে পরীক্ষা করা হয়েছে, তাতে এপিআই গ্র্যাভিটি ২৯ দশমিক ৭। প্রথম দিনের দুই ঘণ্টায় ৭০ ব্যারেলের মতো তেল উঠেছে। এটিকে আমরা এখন বন্ধ রেখেছি। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। তারপর এটির পুরো মজুত জানতে পারব। এবারের তেল সন্ধানের সম্ভাবনা কতটুকু স্থায়ী এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আমরা আগামী ৪ থেকে ৫ মাস পর জানাতে পারব। এখন ড্রিল করার সঙ্গে সঙ্গেই তেল উঠছে। যে কারণে আগেই ঘোষণা দিয়েছি। ড্রিল বন্ধ রেখে পরে চালু করার পর আবার একই প্রবাহে তেল উঠছে। এ কারণেই আপনাদের প্রাথমিকভাবে জানালাম। আশা করি, মজুতটা স্থায়ী হবে। আমরা এখানে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কাজ করছি। তারা কাজ করবে, পরে সেই তেল পরিশোধন করে ব্যবহার করব।
রবিবার এই কূপে তেল-গ্যাস প্রাপ্তির সংবাদ নিয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনেরও আয়োজন করে জ্বালানি বিভাগ। যেখানে তেলের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্যাসও পাওয়া গেছে জানিয়ে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, এই কূপের চারটি স্তরে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম স্তরে আমরা তেলের সন্ধান পেয়েছি। নিচের স্তরটি দুই হাজার ৫৪০ থেকে দুই হাজার ৫৫০ মিটার পর্যন্ত পরীক্ষা করে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রবাহ এবং ফ্লুয়েন্ট প্রেসার প্রায় তিন হাজার ২৫০ পিএসআই পাওয়া গেছে। মজুতের পরিমাণ ৪৩ দশমিক ১০০ বিলিয়ন ঘনফুট।
এ সময় প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুই হাজার ৪০-৬০ এবং দুই হাজার ৫০০-৭৫ মিটারের আরও একটি ভালো গ্যাসের স্তর পাওয়া যায়। এখানে পরীক্ষা করলে ২৫-৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি। দুই হাজার ২০০ থেকে ৯০ এবং দুই হাজার ৩১০, এই স্তরেও গ্যাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে এক হাজার ৩৯৭ থেকে এক হাজার ৪৪৫ মিটার গভীরতায় আরও একটি জোন আবিষ্কার করা হয়েছে। যেখানে তেলের উপস্থিতির কথা জানা গেছে।
গ্যাস ও তেলের স্তর ভিন্ন ভিন্ন হওয়াকে সুখবর উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগে আমাদের গ্যাসের সঙ্গে কিছু তেল আসত। যেটিকে আমরা কনডেসার হিসেবে ব্যবহার করতাম। এখন তেল আলাদা হয়ে গেছে। এতে তেল ও গ্যাসের বাজারে প্রভাব পড়ার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা যদি নিজেদের তেল নিজেরা উত্তোলন করতে পারি, যেভাবে আমরা খনন করছি, প্রায় ৪৬টির মতো খনন শুরু করেছি, পরবর্তীতে আরও ১০০ খনন করার প্রস্তুতি চলছে। আমরা আশাবাদী, আগামী দুই বছরের মাথায় ৫০০ থেকে ৬০০ এমএমসিএফ গ্যাস প্রতিদিন তুলতে পারব। ২০২৭ সালের দিকে বাংলাদেশ গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমাদের বছরে ৬ বিলিয়ন টন তেল প্রয়োজন হয়।
প্রায় ৩৭ বছর আগে ১৯৮৬ সালে হরিপুরের গ্যাসক্ষেত্র থেকে খনিজ তেলের সন্ধান মেলে। এরপর টানা সাত বছরে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৬৯ ব্যারেল তেল উত্তোলনের পর ১৯৯৪ সালে কূপটি থেকে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় চার দশক পর সিলেট গ্যাসক্ষেত্রে আবারও মিলল মূল্যবান খনিজ তেলের উপস্থিতি। গেল মাসের শেষ দিকে সিলেটের একটি কূপে গ্যাসের সন্ধান পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস কর্তৃপক্ষ। এমন ঘোষণার দুই সপ্তাহ পর সেখানে খনিজ তেল পাওয়ার সুখবর পাওয়া গেল।
দেশের জ্বালানি সংকটে যখন সারাদেশে ব্যাহত হচ্ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন তখনই চলতি বছরের মাঝামাঝিতে দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স)। দেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে আরও অন্তত ২৯টি পরিত্যক্ত কূপে নতুন করে ওয়ার্কওভারের (সংস্কার) কাজ শুরু করে বাপেক্স। এর বাইরেও পেট্রোবাংলার মোট ৪৬টি অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভার কূপ খননের পরিকল্পনায়ও আনে। ‘ক্রাস প্রোগ্রাম’ নাম দিয়ে এসব কূপে অনুসন্ধান, ওয়ার্কওভার, খনন ও উন্নয়ন কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয় ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ। এরই মধ্যে সিলেট ১০ নম্বর কূপ থেকেই একই সঙ্গে তেল-গ্যাস পাওয়াকে দেশের জ্বালানি খাতের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত উল্লেখ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, দেশীয় চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর আমাদের কাতার, কুয়েতের মতো দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। তাই আমরা সব সময়ই বলে আসছিলাম দেশীয় কূপগুলোতে অনুসন্ধান কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য। দেরিতে হলেও জ্বালানি বিভাগের বোধোদয় হয়েছে। তার ফলই পাওয়া গেল এই তেল প্রাপ্তির মাধ্যমে।