ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আজ বিশ্ব পানি দিবস 

নিরাপদ পানির তীব্র সঙ্কট, বাড়ছে রোগব্যধি 

নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ১০:৩৯, ২২ মার্চ ২০২৩

নিরাপদ পানির তীব্র সঙ্কট, বাড়ছে রোগব্যধি 

পুকুর

সাগরপারের উপকূলীয় জনপদ কলাপাড়ায় পুকুর ভরাটের হিড়িক চলছে। গত দেড় যুগে এখানে অন্তত দুই হাজার পুকুর ভরাট করা হয়েছে। অর্থনৈতিভাবে লাভবান হওয়ার স্বার্থে ব্যক্তি মালিকানা পুকুর ভরাট চলছে। ফলে গোসল, রান্নাসহ নিত্য কাজে ব্যবহারের জন্য পানির সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। 

নিরাপদ পানির সঙ্কটে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে ডায়রিয়াসহ পেটের পীড়াজনিত নানান রোগ বালাইয়ে। আজ বিশ্ব পানি দিবসে নিরাপদ পানির সংকট লাঘবের দাবিতে কলাপাড়ায় ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ, আমরা কলাপাড়াবাসী, উপকূলীয় জনকল্যাণ সংঘ ও পানি জাদুঘর সংগঠন দিবসটি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভা ২২ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। শুরুতে ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিওতে এই প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

সরেজমিনে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, কীভাবে পুকুর ভরাট করা হয়েছে। যে যেভাবে পারছে পুকুর ভরাট করছে। ভরাট করে বাড়িঘরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তোলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পুকুর ভরাট হয়েছে কলাপাড়া পৌর শহরে। এখানে অন্তত চার শ’ পুকুর ভরাট করা হয়েছে। 
ড্রেজার লাগিয়ে বালু দিয়ে ভরাট করে সেখানে তোলা হয়েছে স্থাপনা। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। 

এসব পুকুরের পানি মালিকসহ আশপাশের পড়শিরা গোসল, রান্নাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করত। বর্তমানে অবস্থা এমন হয়েছে যে পৌরশহরে পৌরসভার পানির সরবরাহ একদিন বন্ধ থাকলে জনজীবনে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। মানুষ চরম বিপাকে পড়ছেন। ব্যক্তি মালিকরা পুকুর ভরাট করা ছাড়াও সরকারি বেসরকারি সংস্থাও পুকুর ভরাট কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যেমন পৌর শহরের এতিমখানা পুকুরটি ভরাট করে সেখানে পৌর ভবন তোলা হয়েছে। ওই পুকুরটির পানি প্রতিদিন অন্তত হাজারো মানুষ গোসল রান্নাসহ নিত্যকাজে ব্যবহার করত। 

এভাবে শহরের পুকুর ভরাট চলছে দেদার। একই অবস্থা ১২ ইউনিয়নের প্রত্যেক গ্রামে। পুকুর ভরাট করে এই অঞ্চলে মানুষ বসবাসের চিরচেনা বাড়িঘরের আদল বদলে ফেলছে। পুকুর ভরাটের কারণে  ভূ-উপরিভাগের পানির ব্যবহার আশঙ্কাজনকহারে কমে যাচ্ছে। বাড়ছে ভূপৃষ্ঠের পানির ব্যবহার। চাপ পড়ছে গভীর নলকূপের ওপরে। 

ইতিমধ্যে শতাধিক গভীর নলকূপ নষ্ট হয়ে গেছে। পানির স্তর অঞ্চলভেদে তিন থেকে ১০ ফুট নিচে নেমে গেছে। পুকুর ভরাটের কারণে ব্যবহারের পানির সঙ্কটে গ্রামাঞ্চলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। 

পটুয়াখালী বরগুনা মৎস চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প পরিচালিত ১৯৯৮ সালের এক জরিপের তথ্য মতে, কলাপাড়ায় মোট পুকুর সংখ্যা ১৭ হাজার এক শ’ ৩৪ টি। এর মধ্যে বড় পুকুর (এক হাজার বর্গ মিটারের বেশি) ছিল ১৫৬৪টি। মাঝারি পুকুর ১০ হাজার ৫৪ টি। ছোট পুকুর ছিল পাঁচ হাজার দুই শ’ ৭৮টি এবং ডোবা ছিল ২৩৮টি। 

এছাড়া খাস পুকুর ছিল ১০৮টি। বর্তমানে অর্ধেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ওই তথ্য মতে, কলাপাড়া পৌর শহরের পুকুর সংখ্যা ছিল ৬৪০টি। যার দুই তৃতীয়াংশ ভরাট হয়েছে বলে দাবি পৌরবাসীর। লতাচাপলী ইউনিয়নের দৃশ্য একই। সেখানে ওই সময় পুকুর ছিল ১৮৮০টি। যার দুই তৃতীয়াংশ ভরাট করা হয়েছে। কুয়াকাটা পৌরসভা এবং লতাচাপলীতে ব্যক্তি মালিকানাসহ সরকারি খাস পুকুর পর্যন্ত ভরাট করে বিক্রি করা হয়েছে। 

কুয়াকাটার মাঝিবাড়ি এবং খাজুরা এলাকায় শরীফপুর এলাকাজুড়ে পুকুরের পাশাপাশি সরকারি অন্তত ৫টি দীর্ঘ খাল ভরাট করে বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়েছে। সেখানে এখন ব্যবহারের পানি তো দুরের কথা। মানুষ বসবাস করাও দুরুহ হয়ে গেছে। সেখানকার হাজারো লোকজন এসবের প্রতিবাদে কয়েক বছর আগে মানবন্ধন পর্যন্ত করেছে। 

কলাপাড়া পৌরসভায় সরকারি হিসাবে ২৪টি খাস পুকুর রয়েছে। তার অর্ধেক এখন ভরাট হয়ে গেছে। নাচনাপাড়া চৌরাস্তা এলাকায় একটি খাস পুকুর ভরাট করে সেখানে এখন ফ্রি-স্টাইলে তোলা হয়েছে স্থাপনা। লতাচাপলীর রাখাইন পল্লী কালাচানপাড়ায় সরকারি খাস পুকুর দখল করে সেখানে বহুতল মার্কেটসহ অসংখ্য স্থাপনা তোলা হয়েছে। পুকুর দু’টির পানি এখন দুষিত। মানুষ বর্জ্য ফেলে ভাগাড়ে পরিণত করেছে। বর্তমানে ফ্রি-স্টাইলে তাৎক্ষণিক লাভের আশায় পুকুর ভরাট করে নিরাপদ পানির ব্যবহারে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। 

প্রাকৃতিক জলাধার আইনানুসারে কোন ধরনের পুকুর ভরাট করার সুযোগ নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আইনের প্রয়োগ নেই। পৌরপরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ পরিবেশ অধিদফতর রয়েছে। কিন্তু মানুষের সবচেয়ে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন নিরাপদ পানির উৎসগুলো পুকুর দেদার নষ্ট হয়ে গেলেও তারা রয়েছেন নির্বিকার। কোথাও কোন আইনের প্রয়োগ নেই। সামাজিক কোন দায়বদ্ধতা পর্যন্ত নেই। 

কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসক ডা. চিন্ময় হাওলাদার জানান, পুকুর ভরাটে নিরাপদ পানির সঙ্কট রয়েছে। ফলে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগব্যধি বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি জীবন যাপনে ভয়াবহ বিপর্যস্ত পরিবেশের শঙ্কা রয়েছে। পরিবেশ বিশেষঞ্জের মতে, পৌর এলাকায় ব্যক্তিগতভাবে পুকুর খনন কিংবা ভরাটের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। 
 
এ ব্যাপারে কলাপাড়া পৌর মেয়র বিপুল চন্দ্র হাওলাদার জানান, পরিকল্পিতভাবে যেসব পুকুর জনস্বার্থে সংরক্ষণ করা দরকার তা রক্ষার্থে পুনর্খনন করার উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। 
 

 এসআর

×