ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ব্যবহারে সচেতন হওয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের 

দিনে গড়ে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

দিনে গড়ে দুটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ

গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ

১১ বছরের ছোট্ট শিশু লাবণী। পৃথিবীর আলো-বাতাস কিছুই তেমন অনুভব করা শিখে উঠতে পারেনি। কিন্তু বাবা-মায়ের আদর-ভালবাসায় সুন্দর পৃথিবীতে বেড়ে ওঠা হলো না তার। ভয়াবহ এক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বাবা-মায়ের সঙ্গে মারা যায় সেও। শরীরের ২২ শতাংশ পুড়ে যাওয়া লাবণীকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা।

মারাত্মক এই ঘটনা সাধারণ মানুষকে শিহরিত করলেও অনেকটা নীরব ভূমিকাতেই ছিল প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহল। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে দুটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এর বেশিরভাগই বাসা-বাড়িতে। আর এ বিস্ফোরণের জন্য অন্যতম দায়ী ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ। তাই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে আরও সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 
সাম্প্রতিক যত দুর্ঘটনা ॥ গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হন গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে। গ্যাস সিলিন্ডার লিক হয়ে আগুন লেগে ওই পরিবারের চারজন দগ্ধ হয়। ওই দিনই তাদের শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। পরদিন চিকিৎসাধীন পরিবারের কর্তা লাবণীর বাবা জাহিদ মিয়া মারা যান। এর পর চলতি বছরের শুরুর দিন অর্থাৎ ১ জানুয়ারি মারা যায় শিশু লাবণী। এ ঘটনায় লাবণীর মা আক্তারের শরীরের ২৩ শতাংশ ও ভাই ইয়াছিনের শরীরের ৮ শতাংশ পুড়ে যায়। 
চলতি মাসের ২ তারিখ রাজধানীর ভাটারায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় আব্দুল মজিদ শিকদার ও তাসলিমা বেগম নামে এক দম্পতির। উভয় ঘটনায়ই পুলিশ ঘরের গ্যাস সিলিন্ডারে লিকেজ ছিল বলে জানায়। চুলায় আগুন ধরাতে গিয়েই প্রাণ দিতে হয় তাদের। এর কিছুদিন আগেই মিরপুরে বেলুনে গ্যাস ভরতে গিয়ে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রাণ হারান সিদ্দিক মিয়া নামের ৬০ বছর বয়সী ব্যক্তি।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান ॥ ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, রাজধানীতে অগ্নি দুর্ঘটনার প্রায় ৩০ ভাগই গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে। বিভিন্ন শহরে যে গ্যাস সরবরাহ লাইন সম্প্রসারিত হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। খোদ রাজধানীতে অর্ধশত বছরের পুরনো লাইনও রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ অবৈধ সংযোগ। গ্যাসের মতো অতি দাহ্য পদার্থের সঞ্চালন, সরবরাহ লাইন সংযোগ করতে হয় শতভাগ টেকসই, নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্তভাবে।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এসব দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, দেশের গ্যাস সরবরাহ লাইন ও সংযোগ কতটা ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসাবাড়িতে গ্যাসলাইন বসানোর কাজ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু তারা একবার লাইন বসানো ও সংযোগ দেওয়ার পর খোঁজও নেয় না, সেটি কী অবস্থায় আছে। অনেক সময় গ্রাহক তাদের সহায়তা চেয়েও পান না। বাধ্য হয়ে তারা আনাড়ি মিস্ত্রিকে দিয়ে মেরামতের কাজ করান। ফলে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক বড় দুর্ঘটনা।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে দুর্ঘটনার সংখ্যা ছিল ৮৯৪। অর্থাৎ দিনে গড়ে দুটির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহা. নায়েব আলী জনকণ্ঠকে বলেন,  দুর্ঘটনাগুলো মূলত গ্যাসের লিকেজ থেকে ঘটে। সিলিন্ডারের হোস পাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস ভালভের মতো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের ত্রুটির কারণে গ্যাস লিক হয়। সেই লিকেজ থেকে গ্যাস বেরিয়ে বাইরে কোথাও জমতে থাকে। সামান্য আগুন, এমনকি স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমে থাকা সেই গ্যাস ভয়াবহ বিস্ফোরণের সৃষ্টি করে। 
গতানুগতিক তদন্ত ॥ গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনার পর সাধারণত তদন্ত করে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। তাতে গতানুগতিক কিছু সুপারিশ থাকে বলে অভিযোগ আছে। বিশেষ কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষতি কমানো যায় কিনা সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা থাকে না। এ বিষয়ে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহা. নায়েব আলী বলেন, যে কোনো বড় ঘটনার তদন্তে আমরা শতভাগ তৎপর। বাসা-বাড়িতে লিকেজ তো ব্যক্তি পর্যায়ে নজরদারি জরুরি। ব্যক্তির নিজের সচেতনতাও এমন বড় দুর্ঘটনা রুখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা দুষছেন বিস্ফোরক পরিদপ্তরকে। তাদের দাবি, একটি গ্যাস সিলিন্ডার ন্যূনতম ২০ বছর ব্যবহার করার কথা। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, এ সময়ের মধ্যে কয়েক দফায় রেগুলেটর ও ভালভ পরিবর্তন করতে হয়। এ দুটি যন্ত্রাংশই মূলত গ্যাস লিকেজ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশের সিলিন্ডারগুলোয় মানহীন রেগুলেটর ও ভালভ ব্যবহারের ফলে লিকেজ সৃষ্টি হয়। অথচ সিলিন্ডার ও এতে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের মান পরীক্ষার দায়িত্ব বিস্ফোরক পরিদপ্তরের। কিন্তু যথাযথভাবে এসব গ্যাস সিলিন্ডারের মান পরীক্ষা করা হয় না। আর এ সুযোগে বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে মানহীন গ্যাস সিলিন্ডার ও এতে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ।
চিকিৎসার রয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ॥ যে কোনো অগ্নিকা-ে বা সিলিন্ডারে দগ্ধ রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা এই সরকার করেছে জানিয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোনো দগ্ধ রোগীকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার সুবিধা আমাদের রয়েছে। কিন্তু সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বেশিরভাগ রোগীরই অবস্থা খুবই খারাপ থাকে। এদের এমনও হয় যে ৯৯ শতাংশও পুড়ে যায় শরীরের। তখন আর তাদের বাঁচানোর সুযোগ থাকে না। 
তাই সতর্কতার বিকল্প নেই জানিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আয়েশা আক্তার বলেন, বাসা-বাড়িতে আমরা যখন সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার করব তখন অবশ্যই সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। চুলা জ্বালানোর আগে জানালা খুলে গ্যাস বাইরে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। কোথাও কোনো লিকেজ রয়েছে কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই যে উত্তম।
দেশে এলপিজির গ্রাহক সংখ্যা ॥ জানা যায়, দেশে বর্তমানে ৬০ লাখের বেশি গ্রাহক এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করেন। এ গ্রাহকের একটি বড় অংশই গ্রামাঞ্চলের। এ মুহূর্তে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৩০টি কোম্পানির অন্তত দুই কোটি সিলিন্ডার বাজারে রয়েছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত এক বছরে এলপিজি সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে ৬ লাখের বেশি। এলপিজি ছাড়া অন্যান্য সিলিন্ডার আমদানি করা হয়েছে ৩ লাখের বেশি। পাশাপাশি দেশেও সিলিন্ডার নির্মাণের জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করেছে দেশে নির্মিত সিলিন্ডার। কিন্তু এসব সিলিন্ডারের মান পরীক্ষার জন্য অনুমোদিত কোনো পরীক্ষা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।
সমাধান হতে পারে গ্যাস ডিটেক্টর যন্ত্রে ॥

যদিও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে বাঁচতে সচেতনতার বিকল্প নেই কিন্তু এর অপর একটি সমাধান হতে পারে গ্যাস ডিটেক্টর যন্ত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু সচেতনতা আর গ্যাস ডিটেক্টর নামের যন্ত্রটি ঘরে স্থাপন করে নিলেই রক্ষা পাওয়া যাবে এ রকম বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে। শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে গ্যাস ডিটেক্টর যন্ত্রের কার্যকারীতা বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরে দেশে এলপিজি ও গ্যাসলাইনের বড় বড় বিস্ফোরণ ঘটেছে। অনেকে মারা গেছেন। মারাত্মক আহতও হয়েছেন অনেকে।

সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময় সতর্কতার নির্দেশনা দেওয়া হলেও গ্যাস শনাক্তকারী যন্ত্রের কথা বলা হয়নি। সাধারণ মানুষের অনেকে জানেই না যে এমন যন্ত্র দেশেই আছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের জন্য প্রচার বাবদ অর্থ বরাদ্দ রাখা হলেও গুটিকয়েক লিফলেট ছাপানো ছাড়া আর কিছুই করতে দেখা যায় না।
তিতাস কি বলছে ॥ বাসা-বাড়িতে চাইলেই গ্যাস ডিটেক্টর যন্ত্র বসানো যায় জানিয়ে গ্যাস বিতরণকারী সংস্থা তিতাস বলছে, এটি পাওয়া যায় বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটেই। দাম ১২০০-২০০০ টাকার মধ্যে। রান্নাঘর বা গ্যাসের লাইন রয়েছে এমন স্থানে এটি স্থাপন করা যেতে পারে। লিকেজ হলেই বেজে উঠবে অ্যালার্ম। যাতে বড় দুর্ঘটনার আগেই লোকজন নিরাপদে সরে  যেতে পারবে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ মোল্লাহ্ জনকণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনার পর আমরা গ্যাস ডিটেক্টর নিয়ে ভাবছি। গ্রাহকরা এটি কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তবে এটি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তিনি জানান, এটি স্মোক ডিটেক্টরের মতো ছোট একটি ডিভাইস। সর্বক্ষণিক বিদ্যুতের সঙ্গে যুক্ত রাখতে হয়। আবার ব্যাটারিতেও চলে। সাধারণত দুই ধরনের ডিটেক্টর পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি যন্ত্র বাতাসে গ্যাসের ঘনত্ব মেপে অস্বাভাবিকতা ধরতে পারলেই সংকেত দেয়। অন্যটি স্থাপন করা হয় গ্যাসের চুলা ও গ্যাস লাইনের মাঝের ভালভে। লিকেজের সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই ডিটেক্টর স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। অবশ্য মূল পাইপলাইনে লিকেজ হলে তা বন্ধ করতে পারে না এই ডিটেক্টর। কিন্তু সংকেত দিতে পারে ঠিকই। একেক ধরনের গ্যাস শনাক্ত করতে পারে একেক ধরনের ডিটেক্টর। তবে বাজারে মিথেন শনাক্তকারী যন্ত্রই পাওয়া যায় বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এলপিজি বাতাসের তুলনায় ভারি। তাই সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে যন্ত্রটি সিলিন্ডারের আশপাশে বা মেঝের কাছাকাছি রাখতে হয়। পাইপলাইনের গ্যাস তুলনামূলক হালকা। তাই এটি লিক হলে ঘরের উপরের দিকে জমা হয়। এ কারণে পাইপলাইনের ডিটেক্টর থাকবে সিলিংয়ে।

×