ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৩ মে ২০২৫, ৩০ বৈশাখ ১৪৩২

সরকারি ক্রয় ও ব্যাংকিং খাতে বেশি

দেশে দুর্নীতি বেড়েছে অবস্থান ১২তম ॥ টিআইবি

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩

দেশে দুর্নীতি বেড়েছে অবস্থান ১২তম ॥ টিআইবি

​​​​​​​যেসব দেশে দুর্নীতির মাত্রা অধিক, সেসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম

যেসব দেশে দুর্নীতির মাত্রা অধিক, সেসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে। ১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২২ সালে বাংলাদেশ দুর্নীতির দিক দিয়ে এই অবস্থানে এসেছে। এর আগের বছর ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম। বছর বাংলাদেশের এক ধাপ অবনমন হয়েছে।

বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০২২ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজধানীর ধানম-িতে মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। সময় বাংলাদেশের অবস্থানকে হতাশাজনক উল্লেখ করেন তিনি।

গতবছর সরকারি খাতে ক্রয় সংক্রান্ত, ঋণ খেলাপি, ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি অর্থ পাচার বেশি হওয়ায় এবং এর সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের জবাবদিহি আইনের আওতায় আনতে না পারায় এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কম হওয়ায় এক ধাপ অবনমন হয়েছে। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ, কাঠামোগত দুর্বলতা দূরীকরণ রাজনৈতিক অঙ্গনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব বলে মনে করছে টিআইবি।  

টিআই বলেছে, তালিকায় ১০০ স্কোরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর প্রাপ্তির ক্রম অনুসারে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্যে ১৪৭তম। আগের বছরও একই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৫, যা গতবারের চেয়ে পয়েন্ট কম। প্রতিবেদন অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান কেবল আফগানিস্তানের ওপরে।

সূচকে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৯০ পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। ৮৭ পেয়ে যৌথভাবে দ্বিতীয় তৃতীয় অবস্থানে ফিনল্যান্ড নিউজিল্যান্ড। আর সবচেয়ে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে সোমালিয়ায়। তাদের স্কোর মাত্র ১২। ১৩ পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে সুদান সিরিয়া।

দুর্নীতি বাড়ার কারণ ২০২১ সালের তুলনায় বাংলাদেশ এক ধাপ অবনমন হওয়ার কারণ এবং গতবছর দুর্নীতি বাড়ার কারণও ব্যাখ্যা করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি বলেন, মেয়াদের আগে চলমান যে দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলো আরও ঘণীভূত হয়েছে। গতবছর সরকারি খাতে ক্রয় নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। কোভিড সংক্রান্ত কেনাকাটায়ও ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে। অর্থ পাচার, ঋণ খেলাপি, ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতির দিক দিয়ে দুর্নীতি ব্যাপক আকারে বেড়েছে।

অথচ এক্ষেত্রে কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যারা এসব অনিয়ম করেছে, তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার অধিকারী। আর এই প্রভাবশালীদের জবাবদিহির আওতায় আনার প্রমাণ একেবারেই কম। আমাদের দেশে অর্থ পাচার দুর্নীতির বিষয়ে গত ১০ বছর ধরে আলোচনা বেশি হচ্ছে। কিন্তু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখেছি, দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করা কিংবা দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে উল্টো হয়রানি করা হয়েছে।

দুদকসহ যেসব সংস্থা দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে, দুর্নীতি দমনে তাদের তেমন ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বরং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে উল্টো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর  যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতি করেছে, তাদের আরও পুরস্কৃত করার নজির রয়েছে।  তিনি বলেনদুদকের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে আমলাতান্ত্রিকতা থেকে বের হতে হবে। দুর্নীতির রাঘব-বোয়ালদের ধরার মতো বড় কোনো উদাহরণ তৈরি করতে পারেনি দুদকসহ অন্যান্য সংস্থা। দুর্নীতি বৃদ্ধি পাওয়ার বড় কারণ হলো গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ, যাদের লেখনী কণ্ঠে দুর্নীতিবিরোধী বিষয় উঠে আসে তাদের সুন্দর পরিবেশ সংকুচিত করা হয়েছে। ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কম হয়েছে।

দুর্নীতির লাগাম টানতে পরামর্শ যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, ব্যাংক খাত, অর্থনৈতিক সব খাতসহ আমাদের মৌলিক যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে রাজনৈতিক আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বেড়ে চলেছে। দুর্নীতি কমাতে হলে, বৈশ্বিক সূচকে উন্নতি করতে হলে এসব প্রভাব থেকে বের করতে হবে। একইসঙ্গে তাদের দক্ষতা, উৎকর্ষতা, শুদ্ধাচারের মাধ্যমে সফল হওয়ার প্রত্যাশা করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা সয়ংক্রিয় তথ্য লেনদেনের মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। বিভিন্ন দেশ সেটি অর্জন করতে পারলেও আমরা এখনো পারিনি। এক্ষেত্রে যারা ঋণ খেলাপি মানিলন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত তাদের জবাবদিহি আইনের আওতায় আনতে হবে। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী আরও তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। পাবলিক সেক্টরে সহজ হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এসব দুর্নীতির ক্ষেত্রে রাজনীতিকে ক্ষমতার লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে সবচেয়ে বেশি দরকার রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা। আর এটি দেখার দায়িত্ব রাজনৈতিক দল ব্যক্তির।

একটি দেশে দুর্নীতির মাত্রা অধিক হলে কি ধরনের সমস্যা পোহাতে হয়, সেই দিকও তুলে ধরেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, যেসব দেশে সংঘাত কিংবা যুদ্ধ লেগে থাকে সেসব দেশের স্কোর একেবারে কম। তার মানে সেসব দেশে দুর্নীতির মাত্রা অধিক। তিনি বলেন, দুর্নীতি নিরাপত্তাহীনতা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করে। সামাজিকভাবে টেনশন বাড়ায়। এতে সরকারের ওপর আস্থা গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে। দুর্নীতির মাত্রা অধিক এমন দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এবং বলপ্রয়োগ করে তা প্রতিহত করা হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আমাদের দেশের মতো অনেক দেশের অর্থ পাচারকে সুযোগ করে দেয়। এতে ওইসব দেশের জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নির্বাচনকে সামনে রেখে দুর্নীতির এই প্রতিবেদন কিনা এবং এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু- এমন প্রশ্নে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে এই রিপোর্ট প্রকাশের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। প্রতিবেদনটি এই সময়েই প্রকাশ করা হয়, তাই হয়েছে। মঙ্গলবার অন্যান্য দেশেও এটি প্রকাশ করা হয়েছে। ১৪টা আন্তর্জাতিক জরিপের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তবে টিআইবির প্রতিবেদন নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকলে আরেকটি গবেষণা করে তা তুলে ধরার পরামর্শ দেন তিনি। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা আমরা দেখতে পেয়েছি। তবে সেটার বাস্তবায়নে যাদের দায়িত্ব তারাই যদি দুর্নীতি করে তাহলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা পূরণ হবে না। তার মতে, বৈশ্বিক দুর্নীতি বেড়েছে, তাই বাংলাদেশেও দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে।

তিনি বলেন, দুদকসহ যেসব সংস্থা দুর্নীতি দমনে কাজ করে তাদের উচিত সরকারকে নয়, রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণে, আমলাতান্ত্রিক প্রভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। তাই এর সঙ্গে যারা জড়িত এবং দুর্নীতি করে তাদের চিহ্নিত করে অর্থ ফেরত আনা, তাদের আইনের আওতায় আনা আইন অনুযায়ী তিনগুণ বেশি অর্থদ- করার দাবি জানান তিনি।

×