
বিদ্যার দেবী সরস্বতীকে অঞ্জলি নিবেদন করছেন ভক্তরা। ঢাবির জগন্নাথ হল থেকে তোলা
এখন পূজা উৎসব মানেই থিম। ট্রাডিশনের সঙ্গে ট্রেন্ড মিলিয়ে নতুন কিছু করার প্রতিযোগিতা এখন পাড়ায় পাড়ায়। এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই সরস্বতী পূজাও। সাবেক প্রতিমার সঙ্গে এখন দেখা মিলে থিমের ঠাকুরও। বৃহস্পতিবার সরস্বতী পূজাতেও ছিল থিমের ছড়াছড়ি। ছোট্ট শিশুদের হাতেখড়ি আর ভক্তদের দেবী বন্দনায় সারাদেশে উদ্যাপিত হলো সরস্বতী পূজা।
ভালো বিদ্যার আশায় দেবীর পায়ে বই সমর্পণ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাই অলিখিতভাবে অনেকেরই পড়াশোনা থেকে ছুটি অন্তত ২৪ ঘণ্টা। দেবীর কাছে রাখা বই ফের ফিরেছে পড়ার টেবিলে। বেলপাতায় লিখা হয় দেবতাদের নাম। ফুলসহ পাতা থাকবে বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে। শুরু হবে নতুন উদ্যমে শিক্ষার যাত্রা।
বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সারাদেশে বিদ্যাদেবী সরস্বতী পূজা উদ্যাপিত হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় এ উৎসবকে ঘিরে সারাদেশেই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। সারাদেশের মন্দির ও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভক্তরা বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠার্থী দেবী সরস্বতীর পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলী অর্পণ করেছেন। ম-পে ম-পে পূজার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও হাতেখড়ি, প্রসাদ বিতরণ, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সন্ধ্যারতি, আলোকসজ্জা ও মেলা বসেছে।
ঢাক-ঢোল-কাঁসর আর শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত ছিল রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন পূজাম-প। সরস্বতী বিদ্যার ও ললিতকলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পুজিত হন। ঐশ্বর্যদায়িনী, বুদ্ধিদায়িনী, জ্ঞানদায়িনী, সিদ্ধিদায়িনী, মোক্ষদায়িনী এবং শক্তির আঁধার হিসেবে সরস্বতী দেবীর আরাধনা করা হয় ম-পে ম-পে।
বিদ্যা ও জ্ঞান বৃদ্ধির আশায় প্রতি বছরের মাঘ মাসের শুক্ল পঞ্চমীতে এই পূজা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তাদের কাছে শ্বেত পদ্মে আসীনা সরস্বতী হলেন বিদ্যা, বাণী ও সুরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, যার হাতে আছে বীণা আর বই। সারাদেশে বিভিন্ন মন্দিরের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ঐতিহ্যগতভাবে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয় এবারও। তবে সবচেয়ে সব পরিসরে এবারের আয়োজনটি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে।
সকাল থেকে ভক্তদের ঢল নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। এছাড়াও রামকৃষ্ণ মিশনসহ বিভিন্ন মন্দিরে দেখা গেছে ভক্তদের উপচেপড়া ভিড়। সন্ধ্যায় বিভিন্ন ম-পে সন্ধ্যা আরতি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ম-পে ম-পে ছিল বর্ণিল আলোকসজ্জা।
এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে বিভিন্ন বিভাগের অসংখ্য ম-পে সরস্বতীর আরাধনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হল, কুয়েত মৈত্রী হল, শামসুন্নাহার হল ও কবি সুফিয়া কামাল হলেও আলাদা ম-পে বিদ্যাদেবীর অর্চনা হয়েছে। বরাবরের মতোই জগন্নাথ হলের পুকুরের মাঝে বিশাল সরস্বতী প্রতিমা গড়েছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সকালে দেবীকে দুধ, মধু, দই, ঘি, কর্পূর ও চন্দন দিয়ে স্নান করানো হয়। জগন্নাথ হল মাঠে সকাল ৯টার দিকে শুরু হয় বাণী অর্চনা। পুরোহিত ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যা কমল লোচনে/বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহী নমোহস্তুতে’ মন্ত্রপাঠ করে দেবীর আশীর্বাদ কামনা করেন। এরপর ভক্তরা দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি দেন। পূজা শেষে ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
জাতীয় সংসদের উদ্যোগে এবারও রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয় স্কুল মাঠে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়। পূজাম-প পরিদর্শনকালে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে তরুণ সমাজকে জ্ঞানার্জনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডেভিডেন্ডে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
নবপ্রজন্ম জ্ঞানাজ্ঞনের মাধ্যমে দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করলেই কেবলমাত্র দেশ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।
পংকজ দেবনাথ এমপির উপস্থাপনায় স্পিকার ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপি এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা উপস্থিত হয়ে পূজাম-প পরিদর্শন ও শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এমপি, হুইপ ইকবালুর রহীম এমপি, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ড. বীরেন শিকদার, অসীম কুমার উকিল এমপি, মনোরঞ্জন শীল গোপাল এমপি, খোদেজা নাসরিন আক্তার এমপি, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আবদুস সালামসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। রাতে ম-পে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়।
দ্বিতীয় বছরের মতো জাতীয় প্রেসক্লাবের উদ্যোগে সরস্বতী পূজার আয়োজন করা হয়।
পূজা কমিটির আহ্বায়ক সুভাষ চন্দ বাদলের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত পূজাতে গণমাধ্যমের অসংখ্য প্রবীণ-নবীন সাংবাদিক ছাড়াও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল এমপি, মনোরঞ্জন শীল গোপাল এমপি পূজাম-প পরিদর্শন করেন। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এছাড়া জয়কালী মন্দির রোডের রামসীতা মন্দির, ইসকন মন্দির, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা), ব্যাংকার্স পূজা পরিষদ, ঠাঁটারীবাজার শিব মন্দির, বিহারী লাল জিউ মন্দির, রাধাগোবিন্দ জিও ঠাকুর মন্দির, রাধামাধব বিগ্রহ মন্দির, মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, তিতুমীর কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও কলেজ, বাংলা কলেজ, ভিকারুন নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইমপিরিয়াল কলেজ ও স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।