ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ভুল শিখছে শিক্ষার্থীরা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০০:১০, ১ ডিসেম্বর ২০২২

ভুল শিখছে শিক্ষার্থীরা

নোট গাইড বা সহজ পাঠ্য

নোট গাইড বা সহজ পাঠ্য। যাই বলা হোক না কেন। নতুন বছরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই আসার সঙ্গেই বাজারে সয়লাব হয় এসব বই। রঙিন মলাটে শিক্ষার্থীদের হাতেও পৌঁছে যায়। কিন্তু এসব বইয়ের ভেতর কী আছে তা কি অভিভাবকরা খুলে দেখেছেন? মূলত এসব নোট-গাইডের নামে অভিভাবকরা সন্তানের হাতে মাদক তুলে দিচ্ছেন বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। সপ্তম শ্রেণির লেকচার, পাঞ্জেরীসহ অন্যান্য গাইডেও মিলেছে এর প্রমাণ। প্রতিটি বিষয়ের এসব গাইড বইয়ে ভুলের ছড়াছড়ি দেখা গেছে।
দেশের প্রচলিত আইনে বলা আছে অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত নোট-গাইড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে উচ্চ আদালত ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা আছে। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে এসব ব্যবসায়ী নোট গাইডের নাম বদলে সহায়ক বই আকারে বাজারে বিক্রি করছেন। অভিযোগ আছে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ক্ষমতা ও টাকার বিনিময়ে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে শিক্ষার্থীদের হাতে নোট গাইড তুলে দিতে বাধ্য করছে। যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সপ্তম শ্রেণির লেকচার পাবলিকেন্সের বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইয়ের রচনা ও সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছেন দেশসেরা ১৬০ স্কুলের বিষয়ভিত্তিক মাস্টার ট্রেইনার ও বোর্ড পরীক্ষক। এই গাইডে (সহায়ক বই) এমনটিই তারা দাবি করেছে। কিন্তু তারা কোন ১৬০ স্কুলের দেশসেরা তা বলা হয়নি।

এমনকি এনসিটিবি থেকে এমন কোনো মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হয়েছে কিনা এ বিষয়ে খোদ এনসিটিবি  সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জনকণ্ঠকে কিছু বলতে পারেননি। তিনি বলেন, নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা আইনের ফাঁক গলে ব্যবসা করছেন। এর ফলে  শিক্ষার্থীর মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হচ্ছে না। কারণ গাইড নির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থীর চিন্তা ভাবনাও একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

লেকচারের গাইড বইয়ে লেখা আছে- ‘বাল্যবিবাহ একটি সম্মানজনক অপরাধ’, সৃষ্টির সেবা নিন্দনীয় আখলাখ, সকল ধর্মের মূল শিক্ষা হচ্ছে মানুষে-মানুষে বিরোধ, দেশের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত সামগ্রী বিদেশে পাচার করা হয়, কৃষি আমদানি হওয়ায় বাংলাদেশকে কৃষিপ্রধান দেশ বলা হয়, এই গাইডে আরও লেখা মা-খালারা বিয়ের কনেকে হলুদ দিতে পারবেন না। দেশে বেশি বৃষ্টিপাতের ফলে খরা দেখা দেয়, গ্রিন হাউজ গ্যাস বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী বনভূমি ও বায়ুম-ল।
তাদের ইংরেজি গাইডে লেখা- পিপল মাস্ট বি আওয়ার্ডেড অ্যাবাউট দ্য হরোবল রেজাল্ট অফ এইচআইভি। যার অর্থ দাঁড়ায় এইচআইভি বা এইডস রোগে পুরস্কৃত করা হবে। এই গাইডে যারা মাদক সেবন করবে তাদের সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়া দ্বারা পুরস্কারের মতো উদ্ভট বিষয়ও তুলে ধরা হয়েছে।
এসব বিষয়ে বই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো গাইডে  মানুষে-মানুষে বিরোধকে মূল শিক্ষা বলা হলে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কি শিখছে তা আর বলার অবকাশ থাকে না। মা-খালারা বিয়ের কনেকে হলুদ দিতে পারবেন না- এমন কথা আমাদের সংস্কৃতির ওপর হুমকি দেয়। বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনে সরকার যখন বলছে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ তখন বইতে আমদানি নির্ভরতার কথা বললে শিক্ষার্থীরা উল্টো শিখছে।
পাঞ্জেরীর ৫ম শ্রেণির জন্য ইংরেজি মডেল টেস্ট পেপারসে দেওয়া আছে ‘হুইচ টু ডিজিস ক্যান দ্য পিপল ইন দ্যাট ভিলেজ বি অ্যাফিকটেড উইথ? ইংরেজিতে ক্যান অর্থ পারা। ইংরেজিতে যা দেওয়া আছে তার অর্থ করলে হয়-গ্রামের লোকেরা কি কি রোগে আক্রান্ত হতে সমর্থ। যা সম্পূর্ণ ভুল বাক্য। এটি হওয়া উচিত ছিল  হোয়াট টু ডিজেস আর দ্য পিপল অফ দ্যাট ভিলেজ ভালনারেবল টু। এ ছাড়া ইংরেজিতে লাইক এজ হিউম্যানের জায়গায় আন লাইক এজ হিউমানের মতো অসংখ্য ভুল আছে।

ছোট্ট শিশুদের জন্য শিশুতোষ গ্রন্থের এক স্বপ্নবাজ শিরোনামে ‘সোনামনি’ বইয়ে সোশ্যাল স্টাডিজ এবং বাংলাদেশ এই বইয়ে ড. শাহজাহান খান তপনের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে লেখকের পরিচয়ে দেওয়া হয়েছে- অধ্যক্ষ ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এই লেখক অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু তার নামে এখনো নোট বইয়ে সংস্করণ চলছে। এ ছাড়া এই বইয়ে আরও লেখা আছে উইথ দ্য হেল্প অব কিশওয়ার জাহান অনন্যা। সেখানে লেখা আছে ‘এক্স টিচার’ যা ব্যাকরণগতভাবে ভুল।

সেখানে হেল্প এর জায়গায় কোলাবোরেশন ও এক্স টিচারের জায়গায় ফরমার টিচার হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেন। এক বিশেষজ্ঞ বলেন, একজন মৃত ব্যক্তির নাম ব্যবহার করে জালিয়াতি করা হয়েছে। এভাবে বইয়ের সংস্করণ করা যায় না। এ ছাড়া যারা শিশুদের বইয়ের প্রচ্ছদে এমন কাজ করে সেখানে বাচ্চারা শিখনের বিষয়ে ভয়াবহ বার্তা দেয়। এ বিষয়ে সরকারকে আরও কঠিনভাবে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দেন বিশেষজ্ঞরা।
বই সংক্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের বছরে কয়েক সেট নোট গাইড কিনতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু নোট গাইডে এমন ভুল থাকলে শিক্ষার্থীদের শুধু ন, দেশের মধ্যে জ্ঞানভিত্তিক গণহত্যা চলছে। আর এই ভুল শিখিয়ে কোটি কোটি টাকা ব্যবসা করছে গাইড ব্যবসায়ীরা।
কেন শিক্ষার্থীর হাতে উঠছে এসব বই ॥ দেশের বিদ্যালয়গুলোতে প্রতিষ্ঠান-প্রধানকে হাত করে নোট গাইড ব্যবসায়ীরা। শুধু কমিশন নয়, অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া হয় লাখ লাখ টাকার নগদ অর্থ। এর ফলে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বাজারের নোট গাইড কেনার কথা বলেন। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ দেওয়ার অভিযোগের অহরহ নজির রয়েছে। এর পরই শিক্ষার্থীরা মূলত বই কিনতে বাধ্য হয়। এ ছাড়া নোট বই পড়লে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করবে এমন গুজব ছড়ানো হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বাজার থেকে একাধিক নোট গাইড কেনে।
ঢাকার সরকারি বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছরের শুরুতেই নোট গাইড ব্যবসায়ীর এজেন্টরা বিদ্যালয়গুলোতে ভিড় জমান। যে কোম্পানি শিক্ষকদের যত বেশি টাকা দেন তাদের গাইডই শিক্ষার্থীদের কিনতে বিদ্যালয় থেকে উৎসাহ দেওয়া হয়। এর দায়ভার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
শিক্ষা আইনে কি আছে ॥ ১৯৮০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে নোট-গাইড সর্ম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৬ সালের শিক্ষা নীতিতে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত গাইড নিষিদ্ধ করা হয়।

কিন্তু নোট-গাইড ব্যবসায়ীরা উচ্চ আদালতে রিট করেন। কিন্তু আদালত এই সম্পর্কিত কোনো রায় না হওয়া পর্যন্ত এটি নিষিদ্ধ থাকবে বলে জানায়। এর পরও নোট-গাইড বাজারে ছেড়ে কোটি কোটি টাকা লুফে নিচ্ছে ব্যাবসায়ীরা। শিক্ষা আইনে বলা হয়েছে, নোট-গাইড বই অর্থে বোঝানো হয়েছে, ‘সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সহায়ক পুস্তক ব্যতীত যে পুস্তকসমূহে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও এর আলোকে বিভিন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর লিপিবদ্ধ থাকে, যাহা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয় হয়।’

এ আইনটি চূড়ান্ত হলে এ ধরনের যেকোনো বই চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ হবে। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ার ১৬ ধারার ১ ও ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ধরনের নোট বই বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না। এ বিধান লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব তিন বছর কারাদ- বা অনূর্ধ্ব পাঁচ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। তবে দীর্ঘদিন আইনটি ঝুলে থাকায় গাইড ব্যবসায়ীরা মোড়কে নাম দিয়ে বাজারে বিক্রি করছেন।
যারা জাতীয় বই ছাপায় তারাই গাইড কারবারি ॥ সরকারের দেওয়া বিনামূল্যের বই যারা ছাপাই তারায় আবার নোট গাইড বই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যেকারণে এনসিটিবির বই ছাপানোর কপি যখন তাদের হাতে দেওয়া হয় তখনই বইয়ের আদলে নোট বই তৈরি করতে অসুবিধা হয় না। এ বিষয়ে পুস্তক প্রকাশনীর এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনসিটিবি বইয়ের জন্য যে কপি তৈরি করে তা আমাদের সিডি আকারে দেওয়া হয়।

৫০ এর অধিক পুস্তক ব্যবসায়ী  তাই অক্টোবরের শুরুতে নতুন বইয়ের সহায়ক বই তৈরির প্রস্তুতি নেয়। এর জন্য এনসিটিবির কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত বলেও জানা যায়। শুধু তাই নয়, চলতি বছর সরকারি বই ছাপানোর কাজ যখন কাগজ সংকটে ভুগছে। তখনো পুরোদমে চলছে নোট বই বা সহায়ক বই ছাপানোর কাজ। এ বিষয়ে সম্প্রতি এনসিটিবি পুস্তক প্রকাশনী সমিতির সঙ্গে বৈঠক করেছে। বৈঠকে আপাতত নোট বই ছাপানোর কাজ বন্ধ রাখতে অনুরোধও করা হয়েছে।
যা বলছেন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ॥ এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, একটা জাতিকে ধ্বংস করার জন্য কোনো অস্ত্র লাগে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিলেই জাতি শেষ হয়ে যায়। সহায়ক গ্রন্থে যে ধরনের দৃষ্টান্ত শুনছি তাতে মনে হচ্ছে একটি শ্রেণি সুকৌশলে কাজটি করে যাচ্ছে।

শুধু নোট বই নয়, টেক্সট বইয়েও আমরা মানবতাবিরোধী, ধর্মবিরোধী কথা আছে। শিক্ষা ব্যবস্থার নজরদারিতে যারা আছেন তারা হয় কাজ করছেন না, তা হয় ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করছেন। আমাদের নবীন প্রজন্ম যদি এই শিক্ষা পায় তাকে শিক্ষা বলা যাবে না। এটা অশিক্ষা-কুশিক্ষার নামান্তর।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক জনকণ্ঠকে বলেন, আইনগতভাবে নোট বই বিক্রি বন্ধ। অনেকে সহায়ক বই আকারে এটি বিক্রি করে। আমরা বলি আমাদের এসব বইয়ের দরকার নেই। আমাদের যে টেক্সট বই আছে সেটা হলেই যথেষ্ট। এ সমস্ত বই যারা ছাপায় তাদেরও যোগ্যতা নেই। তারা শুধু ব্যবসার জন্যই বইগুলো বাজারে বিক্রি করছে।

×