ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

চার কারণে কমছে না আটা, চিনি, ভোজ্যতেল

আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যে স্বস্তি নেই

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ২৫ নভেম্বর ২০২২

আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যে স্বস্তি নেই

.

নিত্যপণ্যের বাজারে ডাল চিনি আটা ও ভোজ্যতেলের মতো আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যে স্বস্তি মিলছে না সাধারণ ভোক্তাদের। ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা, মজুত করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট, টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির মতো চার কারণে কমছে না এসব ভোগ্যপণ্যের দাম। চালের সরবরাহ বাড়াতে শর্তসাপেক্ষে আমদানি হলেও বাজারে তার তেমন প্রভাব নেই। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, আলু এবং শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়ায় বাজারের অস্থিরতা কেটে যাচ্ছে। খাল, বিল ও পুকুরের পানি কমে আসায় জোগান বেড়েছে দেশীয় মাছের। উৎপাদিত এসব পণ্যের সরবরাহ বাড়ায় দাম কমতে শুরু করেছে নিত্যপণ্যের বাজারে। ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে শত শত টন চিনি মজুত করে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছে, সম্প্রতি কয়েকটি অভিযানে বেরিয়ে এসেছে সেইসব চিনি। এর আগে ভোজ্যতেল ও চাল নিয়ে একই ঘটনা দেশে ঘটেছে। এ পরিস্থিতি উত্তরণে বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও কঠোর নজরদারির তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, ভোজ্যতেল ও চিনি নিয়ে এবার সবচেয়ে বড় ধরনের কারসাজির সুযোগ নিয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ আরেকদফা দাম বাড়িয়েও ভোজ্যতেল এবং চিনির দাম কার্যকর করা হয়নি। দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যপণ্য আটা নিয়ে ফের শুরু হয়েছে নতুন যড়যন্ত্র। বাড়ছে ডালের দাম। গত এক মাসে প্রতিকেজি সাদা আটায় মানভেদে (খোলা) ৫-৭ টাকা বেড়ে খুচরা বাজারে ৬০-৬৫ টাকায়, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেট আটা প্রতিকেজিতে ৭-১৫ টাকা বেড়ে ৬৫-৭৫ টাকায়, ময়দা খোলা প্রতিকেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৭০-৭৫ এবং প্যাকেট ময়দা ৫-১০ টাকা বেড়ে ৭৫-৮৫ টাকা, মসুর ডাল ছোটদানা প্রতিকেজিতে ১০-২০ টাকা বেড়ে মানভেদে ১৪০-১৫০, মসুর ডাল বড়দানা ৫-১০ টাকা বেড়ে ১১০-১২০ টাকা, চিনি (খোলা) প্রতিকেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ১১৫-১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। নতুন করে দাম নির্ধারণ করা হলেও নির্ধারিত দামের প্যাকেট চিনি এখনো বাজারে সরবরাহ করা হয়নি। চাল দেশে উৎপাদন হলেও অতিরিক্ত প্রয়োজনে বাইরে থেকে আমদানি করা হয়। দাম কমাতে এবার শর্তসাপেক্ষে বেসরকারিখাতে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারি পর্যায়েও আমদানি অব্যাহত রয়েছে।

তবে চালের দাম কমছে না। গত একমাসে মোটা ও সরু চালের দাম না বাড়লেও মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা কেজিপ্রতি ৫ টাকা দাম বেড়ে ৫৫-৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এছাড়া মিনিকেট ও নাজিরশাইল মানভেদে প্রতিকেজি ৭০-৭৫ এবং মোটা মানের স্বর্ণা ও চায়না ইরি ৫০-৫৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে।
এছাড়া গত মাসের প্রথম দিকে সয়াবিন তেলের দাম কমিয়ে আনা হলেও ঘোষণা দিয়ে আবার বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান বোতলজাত প্রতিলিটার সয়াবিন ১৮৫-১৯০ টাকায় বিক্রি হলেও এক মাস আগে ১৭৫-১৮৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাঁচ লিটারের সয়াবিনের ক্যান ৯২৫ টাকায় বিক্রি হলেও একমাস আগে ৮৬০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে খুচরা বাজারে। এছাড়া পামওয়েল খোলা প্রতিলিটার বর্তমান ১২৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হলেও এক মাস পূর্বে ১১২-১২২ টাকায় বিক্রি হয়েছে মানভেদে। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে,  দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার পরই সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে বাজারে। কিন্তু চিনির দাম কার্যকর হয়নি। আগে থেকে চিনির দাম বেশি থাকায় নতুন দাম কার্যকর করছে না অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত একবছরে চিনির দাম বেড়েছে ৪৬ শতাংশ, ভোজ্যতেলে ৫ থেকে ২৫ শতাংশ, আটা ও ময়দায় মানভেদে ৫২ থেকে ৬৬ শতাংশ, চাল মানভেদে ১০-১১ শতাংশ এবং ডালে ২০-৪৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে। অন্যদিকে, পেঁয়াজ ১০-২১ শতাংশ দাম কমেছে। ব্রয়লার মুরগিতে বেড়েছে ৬ শতাংশ, ডিমে ১৬ শতাংশ এবং আলুতে ৬ শতাংশ মূল্য কমেছে।
ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের দ্বিমুখিতার কারণে ভোক্তাদের কষ্ট বাড়ছে। আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য ব্যবসা করছে দেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় কর্পোরেট গ্রুপ। এসব ব্যবসায়ীরা বাজারে একচেটিয়া সুযোগ নিচ্ছেন।

সম্প্রতি নিত্যপণ্যের বাজারে অভিযানে নেমে দাম বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি কর্পোরেট গ্রুপের কারসাজির প্রমাণ পেয়েছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান। ওই সময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চিনি, ভোজ্যতল, ডাল ও গমের (আটা) আমদানি করছে দেশের কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মনোপলি ব্যবসার কারণে বাজারের এই অস্থিরতা। কৃত্রিম সঙ্কট দেখিয়ে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করা হচ্ছে এটা প্রমাণিত। ওই সময় নিজেদের ব্যর্থতা ও দায় স্বীকার করে তিনি বলেন, পুরো ব্যবসায়ী সমাজই যেন নষ্ট হয়ে গেছে। সর্বত্র কারসাজি ও অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা। এটা থেকে ব্যবসায়ীদের বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি জানান, ভোক্তা স্বার্থে দেশে প্রচলিত বেশ কয়েকটি আইন রয়েছে। কিন্তু নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে সেইসব আইন অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় না। এতে করে সাধারণ ভোক্তাদের স্বার্থ সবচেয়ে বেশি বিঘ্নিত হচ্ছে।
দেশে উৎপাদিত পণ্যে অস্থিরতা কাটছে ॥ এ মুহূর্তের সুখবর হলো-দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, আলু এবং শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়ায় বাজারের অস্থিরতা কেটে যাচ্ছে। সপ্তাহ দুয়েক আগেও সবজির দাম ছিল আকাশচুম্বী। সেই সবজির দাম এখন কমতির দিকে। প্রতিদিন বাজারে আসছে মৌসুমি সবজি। একদিকে সরবরাহ বাড়ছে অন্যদিকে কমছে দাম। সবমিলিয়ে সবজির বাজারে ভোক্তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে শুরু করেছেন। তবে শীঘ্রই দাম আরও কমার কথা জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। বর্তমান প্রতিকেজি শিম ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, অথচ এক মাস আগে এই শিম কিনতে ক্রেতাকে খরচ করতে হয়েছে ১৮০-২০০ টাকা। একইভাবে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, গাজর, টমেটোসহ সব ধরনের সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। এক মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি পেঁয়াজে ১৫-২০ টাকা দাম কমে ৪০-৫০, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ৪০-৪৫ টাকা কমে ১৫৫-১৬০ টাকা, ডিম প্রতি ডজনে ৩০-৩৫ টাকা কমে ১২০-১২৫, প্রতিকেজি পুরনো আলুতে ৫ টাকা কমে মানভেদে ২২-২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। খালবিল, পুকুর, জলাশয় ও নদ-নদীতে পানি কমায় দেশীয় সব জাতের মাছের জোগান বেড়েছে বাজারে। সাগর ও নদীতে ইলিশ ধরা পড়ায় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে স্বাদের এই মাছটি। এতে করে মাছের দামও কমতে শুরু করেছে। একমাস আগেও মাঝারি মানের প্রতিকেজি গলদা চিংড়ি ১১০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন সেটি ৬৫০-৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কমেছে বাগদা, চিংড়ি, রুই, কাতলা, পুঁটি ও অন্যান্য মাছের দাম। তবে গরু ও খাসির মাংস আগের মতো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। প্রতিকেজি গরুর মাংস মানভেদে ৬৫০-৭০০ এবং খাসির মাংস ৮৫০-৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সব ধরনের ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে সরকার। এ কারণে কৃষিতে সব ধরনের ভর্তুকি ও নগদ সহায়তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক কৃষিখাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার জন্য অর্থমন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করলে তা গ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী। ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং নিজে উদ্যোগী হয়ে বিষয়টির ফায়সালা করে দিয়েছেন। আইএমএফকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হবে। বিশেষ করে সারে ভর্তুকি কমানো হবে না। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক শেষে জানান, দ্রব্যমূল্য কমানো এবং স্বাভাবিক রাখতে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সারে ভর্তুকি দেওয়া। এছাড়া মৎস্য, পোল্ট্রি এবং টিসিবিতে ভর্তুকি দিয়ে খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনার বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ঋণ প্রদানে বিভিন্ন ধরনের শর্তারোপ করলেও জনস্বার্থে সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে সংস্থাটি।  
আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ ॥ আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরমধ্যে ভোগ্যপণ্য বিশেষ করে চিনি ও ভোজ্যতেল উৎপাদন অব্যাহত রাখতে ইতোমধ্যে মিলগুলোতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ডলার সংকট থাকলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি বা ঋণপত্র খোলার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক খাদ্যপণ্য আমদানিতে এলসি নিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের পাশাপাশি  চাল ও গম আমদানি হচ্ছে বিকল্প বাজার থেকে। চাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও ডালের মতো পণ্য আমদানিতে কর ও ভ্যাট সুবিধা দেওয়া হয়েছে।  এছাড়া বাজার মনিটরিংয়ে আরও কঠোর হচ্ছে সরকার। ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ হলে ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি ও  আটার মতো নিত্যপণ্যের দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যবসায়ীরা মুনাফা করছে। তবে তারা যাতে অতিরিক্ত মুনাফা না করে সেদিকে নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের বেশকিছু দাবি মেনে নেয়ায় বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ছে। আশা করছি, জিনিসপত্রের দামও কমে আসবে।
পণ্যের দাম বেড়েছে কারসাজির কারণে ॥ ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ার  পেছনে কারসাজি হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এছাড়া বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি), বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টেও ব্যবসায়ীদের কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেছে। চিনি ও ভোজ্যতেলে কারসাজি করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। পণ্যের সংকট ও দাম খেয়ালখুশিমতো বৃদ্ধির পেছনে সরবরাহকারী মিল মালিক ও বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীদের পারস্পরিক যোগসাজশের প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। সংস্থাটি দাবি করেছে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত  ভোজ্যতেল, চিনি ও গমের মোট বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পরিমাণ খাদ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। দেশে যে পরিমাণ চিনি মজুত রয়েছে, তা দিয়ে আগামী তিন মাসের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। ভোজ্যতেলের বর্তমান মজুত দিয়ে অনায়াসেই আগামী পাঁচ মাস কাটিয়ে দেওয়া যায়। একইভাবে  দেশে আটা, ডাল ও চালেরও পর্যাপ্ত মজুত আছে। কিন্তু বাজারে পণ্যগুলোর সরবরাহে বিঘœ ঘটছে। চলতি সপ্তাহে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের কাছে গোয়েন্দা সংস্থার এ সম্পর্কিত একটি  প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ৯টি কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের এই সংকট রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
একই সঙ্গে চলমান সংকট নিরসনে ১৩ সুপারিশ করে গোয়েন্দা সংস্থাটি বলেছে, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করে বাজার স্থিতিশীল ও সহনীয় পর্যায়ে রাখতে এখন থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। নতুবা সামনে এই সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ জনকণ্ঠকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকটি দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। কিন্তু এরপরও বেশ কয়েকটি আমদানিকৃত পণ্যের দাম সেভাবে কমেনি। চিনি এখনো নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে।

এসব বিষয় কঠোর নজরদারির মধ্যে আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, এর বাইরে নানা রকম পলিসি দিয়েও বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে যে নয়টি কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে তা হলো-আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে জ্বলানির দাম বৃদ্ধি, জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে পরিবহন ব্যয়সহ কৃষি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানি ব্যবস্থা বিঘিœত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যমূল্য বৃদ্ধি। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে জাহাজ ভাড়া ৩ গুণ বৃদ্ধি, দেশে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও ডলার সংকট। অস্থিতিশীল ডলারের বাজার ও ডলার সংকটে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলায় জটিলতা। একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট, চোরাকারবারি, কালোবাজারি, অবৈধ মজুতদারি ও অধিক মুনাফা লাভের চেষ্টা। শিল্পকারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুতর সংকটে উৎপাদন হ্রাস এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস প্রভৃতি।
তবে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বাজারে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনতে ১৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি, সিন্ডিকেট, দাম বৃদ্ধির অনৈতিক প্রতিযোগিতা, কালোবাজারি ও অবৈধ মজুতদারি বন্ধে কঠোর আইননানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ। পণ্য আমদানি ও বিপণনে সিন্ডিকেট ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চিনিকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ও আখ থেকে চিনি উৎপাদনের হার বৃদ্ধি। প্যানিক বায়িং বন্ধ করতে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি। সার, বীজ, কীটনাশকসহ সব কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি।

বাজারে পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ রাখতে জিটুজি পদ্ধতিতে পণ্য আমদানি এবং বিকল্প রপ্তানিকারক দেশ অন্বেষণ। উৎপাদক বা আমদানিকারক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পণ্য সরবরাহ। এছাড়া কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত পণ্য আড়তদার, পাইকার, প্রক্রিয়াজাতকারী, ফড়িয়া, খুচরা বিক্রেতা থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ। এছাড়া সরকারের চলমান ওএমএস কার্যক্রম আরও জোরদার করতে সারাদেশে কেন্দ্রসংখ্যা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ। মিলকারখানাগুলোর পূর্ণ সক্ষমতায় সচল রাখা এবং যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পণ্য আমদানি নিশ্চিতকরণ। শিল্পকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করে উৎপাদন বৃদ্ধি। নজরদারি বৃদ্ধি ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ডলার পাচার রোধ। ডলারের অবৈধ মজুত ও কালোবাজারি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং কার্যক্র জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ভোগ্যপণ্যের দাম কমাতে করণীয় নির্ধারণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আগামী সচিব সভার বৈঠকেও নিত্যপণ্যের দাম কমানো নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

 

 

×