ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কাল থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ৫ অক্টোবর ২০২২

কাল থেকে ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ

২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকবে

উৎপাদন বাড়াতে ও ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে আগামী ৭ অক্টোবর (শুক্রবার) থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকবে। এ সময় দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে। ইলিশ আহরণে বিরত থাকা জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেবে সরকার।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মৎস্য ভবনে মৎস্য অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
বাংলাদেশে ২০০৩-০৪ সাল থেকেই জাটকা রক্ষার কর্মসূচী শুরু করা হয়। তখন থেকেই ধীরে ধীরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। ২০০৮ সাল থেকে প্রথম আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে ও পরে মিলিয়ে ১১ দিন মা-ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তখন থেকেই এর সুফল দেখতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। তখন তারা গবেষণায় দেখতে পান, শুধু পূর্ণিমায় নয়, এ সময়ের অমাবস্যাতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে।
ইলিশ সম্পদ সংরক্ষণে ‘প্রটেকশন এ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ এ্যাক্ট, ১৯৫০’ এর অধীন প্রণীত ‘প্রটেকশন এ্যান্ড কনজারভেশন অব ফিশ রুলস, ১৯৮৫’ অনুযায়ী এই ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
এই ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় দ-নীয় অপরাধ। আইন অমান্যকারী কমপক্ষে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই বছর সশ্রম কারাদ- অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ইলিশ সম্পদ ধ্বংসকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। দিনে অভিযানের পাশাপাশি এবার রাতেও অভিযান জোরদার করা হবে। সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলায় বরফ কল বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। গত বছরের ন্যায় এবারও অবৈধ জাল উৎপাদনস্থলে অভিযান পরিচালনা করা হবে। অবৈধ পথে ইলিশ পাচার রোধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইলিশ সম্পৃক্ত জেলা-উপজেলায় নদীতে ড্রেজিং বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। ইলিশের নিরাপদ প্রজননের মাধ্যমে ইলিশ সম্পদ উন্নয়নে যা যা করা দরকার তা করতে হবে।
সময় বদলানো জরুরী ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, আমতলী, বরগুনা থেকে জানান,  ইলিশ প্রজনন মৌসুম উপলক্ষে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। কিন্তু গত মাসে সাগরে প্রচুর মা ইলিশ ধরা পড়ছে। এসব ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য উপকূলের নদ-নদীতে আসছিল। আর বর্তমানে যে ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে তা জাটকা। এ কারণে অভিজ্ঞ জেলেদের অভিমত প্রজনন মৌসুম পাল্টে গেছে। কিন্তু সরকার নিষেধাজ্ঞার সময় পাল্টায়নি।
মা ইলিশ প্রজননের উদ্দেশে স্বাদুপানি ও স্রোতের উজানে অগভীর পানিতে উঠে আসে এবং ডিম ছাড়ে। মুক্ত ভাসমান ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছ (জাটকা) নদীর ভাটিতে নেমে সমুদ্রে পৌঁছে বড় হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রজননক্ষম হয়ে জীবনচক্র পূর্ণ করার জন্য আবার নদীতে ফিরে আসে। ইলিশ উচ্চ-উৎপাদনশীল। বড় আকারের একটি ইলিশ ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। ইলিশ সারাবছর ডিম পাড়লেও সবচেয়ে কম পাড়ে ফেব্রুয়ারি-মার্চে ও সবচেয়ে  বেশি  সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে প্রজনন ঋতু নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছের জিএসআই (এড়হধফড় ঝড়সধঃরপ ওহফবী) পরিমাপ পদ্ধতি। জিএসআই হলো মাছের ডিমের ওজন ও দেহের ওজনের অনুপাতের শতকরা হার। সাধারণত  প্রজনন ঋতুতে ডিমের আকার বড় হতে থাকে বলে জিএসআই বাড়তে থাকে এবং ভরা প্রজনন মৌসুমে গিয়ে তা সর্বোচ্চ হয়। প্রজনন ঋতুতে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সময়ে বিগত পাঁচ বছরের জিএসআইর পরিমাপ থেকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ইলিশ সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত প্রজনন করে।

সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে জিএসআই ১০-১১ থেকে বাড়তে বাড়তে অক্টোবরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে এসে সর্বোচ্চ ১৫-১৭ পর্যন্ত পৌঁছায় এবং নবেম্বরে এসে তা হঠাৎ করে কমে যায়। ১৫-১৭ জিএসআই ইলিশের ভরা প্রজনন মৌসুম নির্দেশ করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছর প্রজনন মৌসুম শুরু হবে অক্টোবরের প্রথম দিকে। এ জন্য ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা হওয়া উচিত ছিল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে।
সরকারীভাবে চান্দ্র মাসের ভিত্তিতে প্রধান প্রজনন মৌসুম ধরে এ বছর আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগে চার ও পরের ১৭ দিনসহ মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। সেই হিসেবে ইলিশের প্রজনন মৌসুম আজ মধ্যরাত থেকে ৬ অক্টোবর মধ্যরাতে শুরু।

অনেক অভিজ্ঞ জেলেদের মতে ইলিশ প্রজনন মৌসুম মূলত শুরু হয়েছে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে অক্টোম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এই সময়ে মা ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য উপকূলের নদ-নদীতে আসে।  কিন্তু পুরো সেপ্টেম্বর জুড়ে সাগড়ে মা ইলিশ ধরা পড়েছে। ওই ইলিশগুলোই ডিম ছাড়ার জন্য স্বাদু পানির নদ-নদীতে প্রবেশ করার উপযুক্ত সময় ছিল সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে। কিন্তু সরকার প্রজনন মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে এসে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
পায়রা নদীতে মাছ শিকারি জেলে রহমান গাজী, ছত্তার আকন ও জালাল  বলেন, গত ১৫ দিন পূর্বে থেকে নদীতে প্রচুর মা ইলিশ ধরা পড়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে নদীতে জাটকা ইলিশ ধরা পড়েছে। বর্তমানে প্রজনন মৌসুম হলেও প্রজননক্ষম তেমন বড় ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না। তারা আরও বলেন, ধারণা করা হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে প্রজননের উপযুক্ত সময় ছিল।
আমতলী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা হালিমা সরদার বলেন, ইলিশ সারাবছরই ডিম ছাড়ে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে আশ্বিনের বড় পূর্ণিমা ও অমাবস্যায়। তাই উপযুক্ত সময়েই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার।
ইলিশ গবেষক বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ড. মোঃ আনিসুর রহমান বলেন, আশ্বিন মাসের বড় পূর্ণিমায় মা ইলিশ সবচেয়ে বেশি ও পরিপক্ব ডিম ছাড়ে। ওই বড় পূর্ণিমার দিন পড়েছে ৯ অক্টোবর। আবার একই মাসের অমাবস্যায় বেশি ও পরিপক্ব ডিম ছাড়ে। ওই অমাবস্যার দিন পড়েছে ২৪ অক্টোবর। বড় পূর্ণিমা ও অমাবস্যার তারিখ ঠিক রেখে সরকার ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় নির্ধারণ করেছে। সেই হিসেবে ২২ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ। তিনি জেলের অভিমতকে স্বীকার করে বলেন, সেপ্টেম্বর মাসে মা ইলিশ পরিমাণে কম ডিম ছাড়ে। কিন্তু অক্টোবর মাসে বেশি ডিম ছাড়ে। 

×