ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায় তোয়াব খান

মৃত্যুর হোক লয় 

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২০:২৮, ২ অক্টোবর ২০২২

মৃত্যুর হোক লয় 

তোয়াব খান

তোয়াব খান আর নেই। রিক্ত শূন্য ভাঙ্গা বুক আর অশ্রুসজল আদ্র নয়নে আমরা আগেই জানিয়েছি যে, জনকণ্ঠের সাবেক উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। ৮৮ বছরের দীর্ঘ জীবনে অন্য কোন মোহ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। শুধু কাজ আর কাজ নিয়ে ছিলেন। অবশেষে কর্মময় জগত থেকে ছুটি মিলল তাঁর! এই শরতের শিউলির মতো মিষ্টি ঘ্রাণ বিলিয়ে ঝরে গেলেন। শনিবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। 

বর্ষীয়ান বয়োজ্যেষ্ঠ বিদগ্ধ তোয়াব খান শুধু একটি বা দুটি পত্রিকার নন, বাংলাদেশের গোটা সংবাদপত্র জগতের জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সম্পাদকদের সম্পাদক হিসেবে জ্ঞান করা হতো তাঁকে। যুগস্রষ্টা হিসেবে আজীবন শ্রদ্ধা-ভালবাসা পেয়েছেন। তাঁর বোধের গভীরে ছিল উদারনৈতিক চিন্তা ও প্রগতিবাদী দর্শন। সারাজীবন বাঙালিত্বের অহর্নিশ চর্চা করেছেন। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িকতার আপোসহীন চেতনা শত অন্ধকারের মাঝেও মশালের মতো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্রে এসবেরই বিপুল প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। 

তোয়াব খান চিন্তায় চলায় বলায় ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক ও স্মার্ট। ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব উন্নত চেতনা সুরুচি তাঁকে অন্য অনেকের থেকে আলাদা করেছিল। এত গুণে সমৃদ্ধ হয়েও তিনি ছিলেন নম্র ও বিনয়ী। বেশি কথা পছন্দ করতেন না। স্বল্পভাষী ছিলেন। শুদ্ধচারী ছিলেন। নিভৃতে কাজ করে গেছেন। সাংবাদিকতা পেশার প্রতি এত ভালবাসা, এত নিবেদন আজকের দিনে শুধু বিরলই নয়, বিস্ময় জাগানিয়া। কবিগুরু যেমনটি লিখেছিলেন, ‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যাহা কিছু সব আছে আছে আছে’, তোয়াব খানের চরণের কাছে সত্যি সব মোহর পড়ে ছিল। 

রাষ্ট্রনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। দেশের রাজনীতি তো বটেই, বিশ্ব রাজনীতির গতি প্রকৃতি মেরুকরণ সম্পর্কে আগাম ধারণা দিতে পারতেন। দিনের শুরুতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সবকটি দৈনিক তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। বহির্বিশে^র বিখ্যাত পত্রিকা  ম্যাগাজিন নিয়মিত আসতো তাঁর টেবিলে। বিশ্বগণমাধ্যমের প্রতি মুহূর্তের আপডেট তিনি জানতেন। প্রচুর বই পড়তেন। ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ রাজনীতি ধ্রুপদী সাহিত্য শিল্পকলা ইত্যাদি পাঠে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু আত্মপ্রচার পছন্দ করতেন না। পত্রিকায় নিজের ছবি ছাপানো বা  টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিতে তাঁর অস্বস্তি হত! এ কারণে অনেকে তাঁর নাম জানলেও চেহারায় চিনতেন না।

ছয় দশকের বেশি সময় সাংবাদিকতা করা তোয়াব খান অনন্য এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। সাংবাদিকতায় কয়েকটি প্রজন্ম তিনি নিজ হাতে তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে বহু নবীন প্রকৃত সাংবাদিকতার পাঠ নিয়েছেন। সফল সাংবাদিক হয়ে উঠেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক গণমাধ্যমে তাঁর শিষ্যতুল্য সাংবাদিকেরা গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করছেন।

তোয়াব খানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল। সাতক্ষীরা জেলার রসুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাংবাদিকতা শুরু করেন পঞ্চাশের দশকে। ১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক জনতা দিয়ে বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের শুরু। ষাট টাকা বেতনে সিনিয়র এপ্রেন্টিস সাব এডিটর ছিলেন। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পান। তখন পাকিস্তান আমল। ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় যোগ দেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর দৈনিক পাকিস্তান নাম বদলে দৈনিক বাংলা হয়। তোয়াব খান হন এর যোগ্য সম্পাদক। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ছদ্মনামে লেখা তাঁর ‘সত্য মিথ্যা-মিথ্যা সত্য’ ও ‘সত্যবাক’ কলাম আলাদাভাবে পাঠকপ্রিয় হয়েছিল। 

দৈনিক জনকণ্ঠ প্রতিষ্ঠার একেবারে শুরুতে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে তোয়াব খানকে বেছে নেয়া হয়। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জনকণ্ঠ বাজারে আসে। তখন থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এ পত্রিকায় একই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাঁর সময় জনকণ্ঠ দেশের শীর্ষ দৈনিকে পরিণত হয়। প্রতিকূল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে সুসংহত করতে সাহসী ভূমিকা রেখে চলে জনকণ্ঠ। কর্মময় জীবনের শেষ দিকে পুনরায় দৈনিক বাংলায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন তিনি।

তোয়াব খান ছিলেন ভাষাসংগ্রামী। বাঙালীর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭১ সালে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর অস্ত্র তখনও কলম। স্বাধীন বাংলা বেতারে তাঁর লেখা ও পরিবেশনায় ‘পিন্ডির প্রলাপ’ নামে রাজনৈতিক কথিকা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস এবং মুক্তিকামী মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েছিল। তাঁর হাতে লেখা পিন্ডির প্রলাপ এখন জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত।      

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার প্রতিটি নাগরিক আন্দোলনে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন  তোয়াব খান। সাংস্কৃতিক লড়াইকে এগিয়ে নিতে জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন।  
সাংবাদিকতা ছাড়াও তোয়াব খান সরকার ও রাষ্ট্রের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অত্যন্ত সততা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন। মহান নেতার দেশ গঠনের প্রথম পর্যায়টি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। বাঙালীর নেতা যেদিন জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে ইতিাস সৃষ্টি করেছিলেন সেদিনও সফরসঙ্গী হিসেবে অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন তোয়াব খান। 

তিনি ১৯৭৭ সালে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ পিআইবির পরিচালক পদে যোগ দেন। এর পর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। একই বছর ১৯৮০ সালে তিনি সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। পরে এইচএম এরশাদের সময়ও রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের প্রেস সচিব।  

আরও বহু অর্জন অভিজ্ঞতা তোয়াব খানকে আজকের আসনে আসীন করেছিল। সব পড়ে রইল। চলে গেলেন তিনি। তবে কর্মে যে বেঁচে থাকবেন, সে তো বলাই বাহুল্য। ‘অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্তমাঝে, মৃত্যুর হোক লয়।’ মৃত্যুর নিশ্চিত লয় হয়েছে, সে হার মেনেছে মহাজীবনের কাছে। ‘মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক/তবে তাই হোক।... অশ্রু-আঁখি- পরে যদি ফুটে ওঠে তব স্নেহচোখ/তবে তাই হোক।’  বিদায় তোয়াব খান। 

×