
পুরান ঢাকার বাংলাবাজার জমিদার বাড়িতে শেষ মুহূর্তের কাজে ব্যস্ত শিল্পী
‘শিউলি ফোটে, শিশির ঝরে, চাঁদ হাসে ওই গগনে, শরত এলো আনন্দেরই বার্তা নিয়ে সনে!’ সত্যি তাই শরত মানেই যেন একরাশ আনন্দ। পুরো বাঙালীর জন্য একরাশ নস্টালজিয়া। শরতের বাতাসে যেন ম ম করে দুর্গাপূজার গন্ধ। মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব হলেও দেশজুড়ে সব ধর্মাবলম্বীর মাঝে তৈরি হয় উৎসবের উন্মাদনা। আর মাত্র ১ দিন পরেই দেশের সবগুলো পূজাম-পে বাজবে শাঁখ, উঠবে উলুধ্বনি। বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে মায়ের পূজা।
আর এর জন্য রাজধানীতে ইতোমধ্যে প্রস্তুত হয়েছে ২৪২টি পূজাম-প। রাজধানীসহ এবার সারাদেশে ৩২ হাজার ১৬৮টি ম-পে হচ্ছে দুর্গাপূজার আয়োজন। দুর্গোৎসবকে ঘিরে নিñিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শতভাগ না হলেও অধিকাংশ ম-পেই বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। শপিং সেন্টারগুলোতে চলছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা। বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতারা বলছেন, নিরাপত্তাজনিত কিছু হুমকি থাকলেও নেয়া হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। তারা আশা করছে অক্টোবর মাসের প্রথম পাঁচদিন দুর্গাপূজায় উৎসবের আমেজেই কাটাবে দেশবাসী।
নগরীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ঘুরে দেখা গেছে, দুর্গাপূজা উৎসবকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে চলছে ব্যাপক সাজসজ্জা। প্রতিটি মণ্ডপের জন্য তৈরি হচ্ছে দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী, কার্তিক, অসুর, সিংহ, হাস, পেঁচাসহ বিভিন্ন প্রতিমা। অধিকাংশ মণ্ডপের কারিগররাই ইতোমধ্যে শেষ করেছেন প্রতিমার অবয়ব তৈরির কাজ। এখন চলছে রং করার কাজ। শনিবার মহাষষ্ঠীতে হবে মায়ের চক্ষুদান। বৃষ্টি থেকে প্রতিমা বাঁচাতে প্রায় সবগুলো মণ্ডপে ত্রিপলের ছাউনি তৈরি করা হয়েছে।
নগরীর একটি মণ্ডপে কথা হয় প্রতিমা শিল্পী রসময় পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতি বছর পূজার তিন মাস আগে থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজে তার ব্যস্ততা শুরু হয়। এই কয়েক মাস দিনরাত কাজ করতে হয়। তার ১০ জনের একটি টিম রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে ৫ জন কাজ করে। বাকি পাঁচজন কাজ করছে অন্য আরেকটি ম-পের প্রতিমা তৈরিতে। আর মাত্র ১ দিন বাকি আছে দুর্গাপূজার। প্রতিমা প্রায় তৈরি। এখন শুধু রং দিয়ে সৌন্দর্য বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন জেএল ভৌমিক জনকণ্ঠকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত দুই বছর পূজা তেমন জাঁকজমকভাবে হয়নি। তবে আশা করছি, এবার শতভাগ আনন্দের সঙ্গে মানুষ পূজা উদ্যাপন করবে। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও কয়েকটি জায়গা থেকে হুমকি পেলেও সরকার সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, গত বছর কুমিল্লায় একটি মণ্ডপে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থ কোরান শরীফ রেখে আসার পর সেখানকার এবং চাঁদপুর, নোয়াখালী ও রংপুরে হিন্দুদের বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চলে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বেশ কয়েকজন আক্রমণকারীও।
সেই মণ্ডপে কোন ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা না থাকলেও কোরান রেখে আসার ঘটনাটি ধরা পড়ে পাশের কয়েকটি বাড়িতে স্থাপন করা ক্যামেরার ফুটেজে। তাই এবছর বেশিরভাগ ম-পেই সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, রাজধানীর ২৪২ ম-পেই সিসিটিভি ক্যামেরাসহ সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এগুলোর সবগুলোর কাজই প্রায় সম্পন্ন। রাজধানীর বাইরেও স্থায়ী ম-পগুলোতেও ক্যামেরা বসানো হয়েছে। শুধু কিছু অস্থায়ী কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা এখনও বসানো সম্ভব হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি এগুলোও সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসার। তবে সিসিটিভি না থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ তৎপর থাকবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরাও প্রস্তুত রয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্বাস পাওয়া গেছে খোদ পুলিশপ্রধান। পূজাকে সামনে রেখে সোমবার পুলিশ সদর দফতরে নিরাপত্তা সংক্রান্ত এক সভায় পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ বলেন, দুর্গাপূজা ঘিরে কেউ যেন অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড করতে না পারে, সে জন্য বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। সব মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করার নির্দেশনাও দেন তিনি। প্রয়োজনে হ্যান্ডহেল্ড মেটাল ডিটেকটর ও আর্চওয়ে গেট স্থাপন, মণ্ডপে সার্বক্ষণিক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ, নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা প্রবেশ ও প্রস্থান পথের ব্যবস্থা করা, মণ্ডপ ও বিসর্জন স্থানে পর্যাপ্ত আলো, স্ট্যান্ডবাই জেনারেটর/চার্জার লাইটের ব্যবস্থা করা, আজান ও নামাজের সময় উচ্চৈশব্দে মাইক ব্যবহার না করার জন্য পূজা উদ্যাপন কমিটির প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। শুধু তাই নয়, কমিউনিটি পুলিশের সদস্য এবং বিট পুলিশ কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট পূজা উদ্যাপন কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে পূজার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকার অনুরোধ জানান তিনি।
এ সময় জানানো হয়, দুর্গাপূজা নিরাপদে উদ্যাপনে পুলিশ প্রাক-পূজা, পূজা চলাকালীন ও পূজাপরবর্তী তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যে কোন জরুরী প্রয়োজনে জাতীয় জরুরী সেবা-৯৯৯-এ কল করার পরামর্শও দেয়া হয়।
এদিকে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে রাজধানীর বিপণিবিতানগুলো। অনেকেই পূজার মূল কেনাকাটা শেষ করেছেন আগেভাগে, এখন আসছেন শেষ মুহূর্তের আনুষঙ্গিক কেনাকাটা সারতে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে এই কেনাকাটা। শুধু বিপনিবিতান নয় পাশপাশি ফুটপাথের কেনাকাটাও জমজমাট। ক্রেতা আকর্ষণে বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানে দেয়া হয়েছে বিশেষ ছাড়। দুর্গোৎসবকে ঘিরে বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের বাহারি রঙের পোশাকে সেজেছে বুটিক হাউসগুলো। শারদীয় উৎসবের চিরন্তন রূপ তুলে ধরে ত্রিশূল, ওম ও দেবী দুর্গার ছবি আঁকা লাল সাদার পাশাপাশি বর্ণিল রঙের প্রাধান্য দেখা গেছে শাড়ি ও পাঞ্জাবিতে।
তবে সরকারের কৃচ্ছ্র নীতির কারণে রাত আটটায় দোকান-পাট বন্ধ করার কারণে মন খারাপ অনেক বিক্রেতাদের। ক্রেতারাও কিছুটা হতাশ। কারণ বেশিরভাগ ক্রেতাই আসছেন অফিসের কাজ শেষ করে। প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে কিনতেই পেরিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটায় আটটার ঘর। ফলে অসমাপ্ত কেনাকাটা নিয়েই ফিরতে হচ্ছে বাড়িতে।
রাজধানীর মৌচাক মার্কেটে স্বামীর সঙ্গে পূজার কেনাকাটা করতে এসেছেন প্রেয়াশা শর্মা। সবে প্রায় ১০টা দোকান ঘুরে সবে মাত্র একটা শাড়ি পছন্দ হয়েছে, তখনি দোকানির সতর্কতা, বৌদি তাড়াতাড়ি করেন আটটা বাজতে চলল। দেরি করলে কিন্তু বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেবে মার্কেট কর্তৃপক্ষ। মৌচাকের নিনাক্সি শাড়ির দোকানের বিক্রেতা রমজান আলী বলেন, দুই ঈদ আর এই দুর্গাপূজাই আমাদের মূল ব্যবসার সময়। কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত কিছু তো আর করার নেই।
তবে ক্রেতাদের সমাগমে মুখর রাজধানীর ফ্যাশন হাউসগুলো। মগবাজার আড়ংয়ে সপরিবারে কেনাকাটা করতে এসেছেন আদিত্য রায়। বলেন, সারা বছর অপেক্ষা করে থাকি পূজার দিনগুলোর জন্য। গত দুই বছর করোনার কারণে তেমন কিছুই করা হয়নি। গ্রামেও যেতে পারিনি। তাই এবার সব কাজ আগেভাগে শেষ করে কেনাকাটা করছি। সপরিবারে গ্রামে যাব পূজার ছুটি কাটাতে।
বিক্রেতারা জানান, নারীদের ক্ষেত্রে কাতান শাড়ি, রেশমসিল্ক, মিরপুর কাতান, টাঙ্গাইল শাড়ি, বেনারসি শাড়ি, প্রিন্ট শাড়ি, থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে বেশি। পুরুষ ও শিশুরাও বেঁচে নিচ্ছেন পছন্দের পোশাকটি। কেউ পূজার পাঁচদিনের জন্য আলাদা আলাদা পাঁচ ধরনের পোশাকও কিনছেন।
রাজধানীর গাউছিয়ার শাড়ির দোকানিরা বলছেন, কাতান, তসর, সিল্ক ও ভারি কাজের শাড়িগুলো পূজায় বেশি চলে। শিপলু নামের এক দোকানি বলেন, শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। দামের বিষয়ে বলেন, দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা দামের শাড়িই বেশি বিক্রি হচ্ছে। মহামারীর ঘোর অমানিশা পুরোপুরি কেটে আলোর ঝর্ণাধারা ধরণীতে মায়ের আগমনীর মাধ্যমে বয়ে যাবে বলেই বিশ্বাস তাদের।