শুভ জন্মাষ্টমী
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শুক্রবার ঢাকাসহ সারাদেশে বয়ে যায় আনন্দের ফল্গুধারা। ঢাকাসহ সারাদেশেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায় বের করে বর্ণাঢ্য ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল। কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকায় ৪০৭ বছরে ঐতিহ্যবাহী জাতীয় ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে বর্ণাঢ্য সুবিশাল জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রায় হাজার হাজার পুণ্যার্থীদের অংশগ্রহণে পরিণত হয় মিলনমেলায়। শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষের ছিল সরব অংশগ্রহণ, যেন কৃষ্ণ প্রেমের এক অদৃশ্য টানে ছুটে চলেছেন তারা শেকড়ের সন্ধানে।
জন্মাষ্টমীর মহাশোভাযাত্রাপূর্ব সমাবেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, দেশের কোন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়ে কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। আর আপনারা কখনও নিজেদের মাইনরিটি (সংখ্যালঘু) ভাববেন না। এ দেশে আপনাদেরও সমান অধিকার রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর সরকার, এ সরকার সংখ্যালঘুবান্ধব সরকার। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় যারা মন্দিরে হামলা করে তারা দলের নয়- তারা দুর্বৃত্ত। তারা সবার শত্রু। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। তবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে বিএনপি। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তাদের মুখে মায়াকান্না মানায় না। আমরা সবসময় আপনাদের সঙ্গে ছিলাম, আছি এবং থাকব।
শুভ জন্মাষ্টমী উপলক্ষে শুক্রবার দিনের শুরুতেই ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় শ্রী শ্রী গীতাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। গীতাযজ্ঞ পরিচালনা করেন চট্টগ্রামের সীতাকু-ের শংকর মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা। বিভিন্ন সংগঠন দিনব্যাপী মঙ্গলাচারণ, নামকীর্তন, শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠ, কৃষ্ণ পূজা, পদাবলী কীর্তন, দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা সভা, আলোচনা সভা ও ধর্মীয় সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করে।
তবে দিবসটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল বিকেলের বর্ণিল ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমীর মিছিল। এবারের জন্মাষ্টমী মিছিলে নেমেছিল সনাতন ধর্মাবলম্বী লাখো মানুষের ঢল। নির্বিঘেœ ও প্রাণখুলে হাজার হাজার পুণ্যার্থী মনোলোভা ও জৌলুসপূর্ণ মিছিলে অংশ নিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জয়গান গেয়েছেন। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) উদ্যোগে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা বৃহস্পতিবার থেকে স্বামীবাগ আশ্রমে শুরু হয়েছে।
বিকেল তিনটায় সার্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি মনীন্দ্র কুমার নাথের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রমেন ম-লের পরিচালনায় জন্মাষ্টমীর মিছিলের উদ্বোধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিশেষ অতিথির বক্তৃতা দেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান।
ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল উপলক্ষে শুক্রবার দুপুর ২টার পর থেকেই পুণ্যার্থীদের ঢল নামে ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে পলাশীর মোড় পর্যন্ত। জন্মাষ্টমী মিছিল তিনটায় শুরু হওয়ার আগেই হাজার হাজার পুণ্যার্থীদের স্রোতে পুরো এলাকা লোকে-লোকারণ্য হয়ে পড়ে। জন্মাষ্টমীর মিছিলকে সামনে রেখে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। দুপুর থেকেই শত শত পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেন পুরো এলাকা।
বিকেল তিনটায় বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ ও মহানগর সার্বজনীন পূজা উদ্যাপন কমিটির যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর পলাশীর মোড় থেকে জমকালো এই জন্মাষ্টমীর মিছিল বের হয়। সর্বাগ্রে সুসজ্জিত হাতিটানা রথ, জাতীয় পতাকা ও সংগঠনের পতাকাবাহী ঘোড়া, গরুর গইড়, রথ, টমটম, বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার ও অসংখ্য ট্রাকের মিছিল নিয়ে শুরু হয় এই বর্ণাঢ্য ও মনোলোভা ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল।
জন্মাষ্টমী উপলক্ষে পুণ্যার্থীরা যেন প্রাণখুলে ডাকলেন মহাবতার শ্রীকৃষ্ণকে। অনেকটা প্রাণখুলেই হাজারো নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধবনিতা অংশ নেন জন্মাষ্টমীর মিছিলে। শুধু দেশেরই নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত কৃষ্ণভক্ত বিদেশীও নেচে-গেয়ে, সুদীর্ঘ পথ হেঁটেই অংশ নেন জন্মাষ্টমীর মিছিলে। ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ ধ্বনিতে ঢাক, খোল, করতাল, শঙ্খ, উলুধ্বনিতে চারদিক মুখরিত করে তুলে ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর মিছিল শুরু হয়। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ব্যান্ডপার্টি, ঢোল, ঢাক ও লাউড স্পীকারের গান-বাজনার তালে তালে হাজার হাজার পুণ্যার্থী নেচে-গেয়ে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের করুণা চেয়ে তাঁর আবাহন সঙ্গীতে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন।
দীর্ঘ শোভাযাত্রায় অসংখ্য ট্রাকে, টমটমে, রথ ও ঘোড়া ও গরুর গাড়িতে ধর্মাবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রতিকৃতি বহন করা হয়। দীর্ঘপথ হেঁটে চলা ভক্তের হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধার ধ্বনি ছিল- ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বর্ণাঢ্য কয়েকটি মিছিলে মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মের মুহূর্তটি স্মরণ করিয়ে দিতে ছোট ছোট শিশুকে কৃষ্ণের অবয়বে সাজিয়ে মাথায় নিয়ে মিছিলে অংশ নেন ভক্তরা।
জন্মাষ্টমীর জমকালো এই শোভাযাত্রাটি ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে পলাশীর মোড় হয়ে জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট মোড়, বঙ্গবাজার, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ভবন, গোলাপ শাহ মাজার, গুলিস্তান মোড়, নবাবপুর রোড, রায় সাহেব বাজার হয়ে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্কে গিয়ে শেষ হয়। দীর্ঘ এই মিছিলের কারণে ঢাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এই দীর্ঘ পথে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ করেন এই দৃষ্টিনন্দন জন্মাষ্টমীর মিছিল। তবে কোথাও কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
এ দীর্ঘ জন্মাষ্টমীর মিছিলে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, কাজল দেবনাথ, জয়ন্ত কুমার দেব, মঙ্গল চন্দ্র ঘোষ, তাপস কুমার পাল, বাবুল দেবনাথ, নারায়ণ সাহা মনি, শ্যামল কুমার রায়, কিশোর রঞ্জন ম-লসহ অন্য নেতৃবৃন্দ।