
ডলার নিয়ে কারসাজি
মাত্র ছয় মাসে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন থেকে আট গুণের বেশি মুনাফা করেছে বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংক ‘ব্যাংক এশিয়া’। টাকার অঙ্কে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। গত বছরের ছয় মাসে ব্যাংকটি মুনাফা করেছিল মাত্র ২৩ কোটি টাকা। এ যেন রীতিমতো আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো অবস্থা। সঙ্কটে যখন ব্যবসায়ীরা এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট) খুলতে পারছিলেন না তখন বিপুল পরিমাণে ডলার মজুদ করে ব্যাংকটি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আগ্রাসীভাবে মুনাফা করেছে দেশের নামী-দামী বেশ কিছু ব্যাংক। এ পর্যন্ত বেসরকারী ও বিদেশী খাতের ১৪ ব্যাংকের নামের তালিকা পেয়েছে জনকণ্ঠ। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সুযোগ থাকলেও তা বাজারে না ছেড়ে কৃত্রিমভাবে ডলারের দর বাড়ানো হয়। এলসি খুলতে এসব ব্যাংক ডলার প্রতি ৫-১০ টাকা পর্যন্ত লাভ করেছে। আবার কয়েকটি ব্যাংক ডলার সংরক্ষণের তথ্যও গোপন করেছে।
জানা যায়, ব্যাংকগুলোর বিদেশী মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস হচ্ছে রফতানি আয়, রেমিটেন্স, বিদেশী মুদ্রায় আমানত সংগ্রহ এবং বিভিন্ন ধরনের বন্ডে বিনিয়োগ। আবার বিদেশী প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের বিনিয়োগ রয়েছে কোন কোন ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোন ব্যাংক কী পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা সংরক্ষণ করতে পারবে, তার একটি সীমা (এনওপি-নেট ওপেন পজিশন) নির্ধারণ করে দেয়া আছে। আগে ব্যাংকের রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিদেশী মুদ্রা সংরক্ষণ করার সুযোগ ছিল। ডলার বাজারের অস্থিরতা কমাতে গত ১৫ জুলাই তা কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ সীমার বেশি ডলার হাতে থাকলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্য কোন ব্যাংকের কাছে বিক্রি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে ব্যাংকগুলোর। কিন্তু অধিকাংশ ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার মজুদ করেছে। সঙ্কট সৃষ্টি করে সেই ডলার চড়া দামে আবার বিক্রিও করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষায়, ডলার লেনদেন থেকে আগ্রাসীভাবে মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে ডলার সঙ্কট তীব্র করে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করেছে এসব ব্যাংক। এমন কারসাজিতে জড়িত বেসরকারী ও বিদেশী খাতের ১৪ ব্যাংকের নামের তালিকা পেয়েছে জনকণ্ঠ। তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন থেকে সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে বেসরকারী ব্যাংক ‘ব্যাংক এশিয়া’।
যেখানে ২০২১ সালের একই সময়ে ডলার কেনাবেচায় মুনাফা করেছিল মাত্র ২৩ কোটি টাকা। সেখানে তারা এ বছরের প্রথম ছয় মাসে লাভ করেছে ২০০ কোটি টাকা। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৮ গুণ বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে প্রাইম ব্যাংক। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে ৫০৪ শতাংশ বা ১২৬ কোটি টাকা মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। একই সময়ে বিদেশী খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ৫০২ শতাংশ বা ১২০ কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংক ৫০০ শতাংশ বা ১০০ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক ৪১৭ শতাংশ বা ৭৫ কোটি টাকা, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ৪০৩ শতাংশ বা ১১৭ কোটি টাকা, ঢাকা ব্যাংক ৩৫৩ শতাংশ বা ১০৬ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক ৩৪০ শতাংশ বা ১৩৬ কোটি টাকা, সাউথইস্ট ব্যাংক ৩২০ শতাংশ বা ১৩০ কোটি টাকা।
মার্কেন্টাইল ব্যাংক ২৪৫ শতাংশ বা ১২০ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক ২৩৪ শতাংশ বা ৯৭ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ২০৫ শতাংশ বা ১৩৫ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ১৫৯ শতাংশ বা ৪৩ কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক ১৪০ শতাংশ বা ১৩৬ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ছিল খুবই কম। এই সময়েই মূলত ডলার মজুদ করেছে ব্যাংকগুলো। ডলারের তীব্র সঙ্কট শুরু মে মাস থেকে। ওই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাংক যে দরে ডলার কিনবে বিক্রি করবে সর্বোচ্চ ১ টাকা বেশি দরে। তবে কোন ব্যাংক তা মানেনি। বরং ডলারের বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠে।
শুরুতে ডলার সঙ্কটের অজুহাতে এলসি (লেটার অফ ক্রেডিট) খুলতে অস্বীকৃতি জানায় অধিকাংশ ব্যাংক। ওই সময় আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। ওই সময় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ব্যাংকগুলো বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ডলারপ্রতি ৯০-৯৫ টাকা পর্যন্ত আদায় করে ব্যাংকগুলো। আর মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করেছে ৯৮ টাকা পর্যন্ত। এলসি খুলতে এসব ব্যাংক ডলার প্রতি ৫-১০ টাকা পর্যন্ত লাভ করেছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দাম বায়েবিক্র করার সরাসরি নেতৃত্বে দিয়েছেন ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগের প্রধানরা। গত ৮ আগস্ট দেশী-বিদেশী ৬টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করতে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকগুলো হলো- ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, সিব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক এবং বিদেশী খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারী ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান জনকণ্ঠকে বলেন, ট্রেজারি বিভাগের প্রধানের কোন ক্ষমতাই নেই ডলার মজুদ কিংবা বিক্রি করার। পরিচালনা পর্ষদ অথবা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নির্দেশ ছাড়া কোন সিদ্ধান্তই নেয়া যায় না। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ডলার সংরক্ষণ করে দর বৃদ্ধির ‘প্রমাণ পাওয়ায়’ গত বুধবার এই ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে শোকজ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তায় শুধু বলেছেন, ‘নো কমেন্টস’।
আর বহুজাতিক ব্যাংক স্টান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় এক এসএমএসের মাধ্যমে বলেছেন, ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী, ‘তদন্তাধীন বিষয়ে’ কোন মন্তব্য তিনি করবেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শোকজ নোটিস পাওয়া একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এসব নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলা আমাদের জন্য বিপদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কেউ কেউ মনে করেন, আমরা বিভিন্ন পত্রিকায় কথা বলে বাজার অস্থিতিশীল করেছি। তবে তা দিয়ে তো আর কোন ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। যে কারণে বেশি মুনাফার কথা বলা হচ্ছে।’ বাকি তিন ব্যাংকের এমডিদের কেউ ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও সাড়া দেননি।
জানা গেছে, ২০০২ সালে জালিয়াতির মাধ্যমে ভারতীয় এক ব্যবসায়ীর ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে দেশের পাঁচটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে পরবর্তী সময়ে ওই পাঁচ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের অপসারণ করা হয়েছিল। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে ডলার কারসাজিতে ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের মুনাফা করলেও শাস্তি পেয়েছে ‘নামমাত্র’।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ডলার লেনদেন থেকে আগ্রাসীভাবে মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে সঙ্কট তীব্র করে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করেছে এসব ব্যাংক। প্রথমে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এবার একই অভিযোগে এই ছয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্য ব্যাংকগুলোকেও চিঠি দেয়া হবে। এছাড়া প্রতিটি ব্যাংকে আলাদা আলাদা তদন্ত করা হবে। কারণ একই কাজ আরও অনেক ব্যাংক করেছে। অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতার মধ্যে গত বছরের শেষ দিক থেকে ডলারের দাম বাড়ছিল। এরপর ওই মাসের মাঝামাঝি সময়ে খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হার প্রথমবারের মতো ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ বছরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হার প্রথমবারের মতো ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক দফায় দফায় বাজারে ডলার ছাড়ার পাশাপাশি কিছু পদক্ষেপ নেয়ায় সেসময় পরিস্থিতি কিছুটা সামলে উঠতে পারলেও জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আবার এই আন্তর্জাতিক মুদ্রার বিনিময় হার ১০০ টাকা ছাড়ায়। ১১ আগস্ট তা ১২০ টাকা ছাড়িয়ে যায়, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। ডলারের দরে এই সঙ্কটের মধ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, এর পেছনে ‘কিছু কারসাজি’ চিহ্নিত করেছে সরকার। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারও ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদার সঙ্গে বৈঠক করে প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ ১ টাকা মুনাফার সিদ্ধান্ত দিয়েছে।
এবারের সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে কিনা নিয়মিতভাবে তদারকি করে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়। এদিকে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে ৩০ লাখ ডলারের বেশি এলসিতে নিয়মিত তদারকিসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা চলমান আছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে ডলারের বাজারে কিছুটা স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে।