
দিনে ২০ কোটি টাকার চা পাতা নষ্ট
ভরা মৌসুমে চা শ্রমিকদের আন্দোলন দেশের চা উৎপাদন ব্যবস্থাকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। আন্দোলনের কারণে সিলেট ও চট্টগ্রামের ১৬৮ চা বাগানে থেকে দৈনিক ২০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যমানের চা পাতা নষ্ট হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা শ্রমিকরা পালন করছেন অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। নিজেদের দাবি আদায়ে তারা আছেন শক্ত অবস্থানে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চা বাগানগুলোর ওপর। বন্ধ হয়ে গেছে দেশের সব চা বাগান ও কারখানার কার্যক্রম।
চা শ্রমিকরা বলছেন, বর্তমানে তাদের মজুরি হচ্ছে ১২০ টাকা। এ মজুরি ‘অন্যায্য’, ‘অযৌক্তিক’। তাই মজুরি ৩০০ টাকায় উন্নীত করার দাবি নিয়ে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। অপরদিকে মালিক পক্ষ বলছে একজন শ্রমিক দৈনিক প্রায় ৪০০ টাকা সমপরিমাণ সুবিধা পান। সাম্প্রতিক কালের অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও প্রচ- তাপদাহ চা গাছের জন্য ক্ষতির কারণ। সে সাথে চলমান লোডশেডিং সিলেটের চা শিল্পের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চায়ের ভরা মৌসুমে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ। এতে চায়ের গুণগত মান ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার প্রভাব পড়বে রফতানি বাজারে। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর দিয়ে চা উৎপাদনে বাড়ছে অধিক খরচ। এর ওপর বর্তমানে বাগানগুলোতে শ্রমিক আন্দোলন উৎপাদনের ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন হচ্ছে।
চাসংশ্লিষ্টদের মতে, চায়ের মৌসুম শুরু হয় মার্চ-এপ্রিল মাসে আর শেষ হয় নবেম্বর-ডিসেম্বরে। চা উৎপাদনের পিক সিজন হচ্ছে জুন, জুলাই ও আগস্ট-এই তিন মাস। এই পিক সিজনে প্রতিটি বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্ষেত্র ভেদে পাঁচ হাজার থেকে ৭০ হাজার কেজি চা পাতা আসে প্রক্রিয়াজাতের জন্য। এসব পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লাগে। এ কারণে ২৪ ঘণ্টা কারখানা চালু রাখতে হয়।
তারা বলছেন, বর্তমানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ না থাকায় জেনারেটর দিয়ে চা বাগানের কারখানাগুলোর সকল মেশিন ২৪ ঘণ্টা চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এতে নষ্ট হচ্ছে চায়ের গুণগত মান। চায়ের মান খারাপ হলে চা পাতা রফতানিও করা যাবে না। আবার রফতানি করা গেলে সেটি ফেরত আসার আশঙ্কা থাকবে। তখন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশী চায়ের মর্যাদাহানি ঘটবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ড জানিয়েছে, দেশে মোট ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগান আছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের ১৩৫টির বাগানের মধ্যে সিলেটে ১৯টি, মৌলভীবাজারে ৯১টি ও হবিগঞ্জে ২৫টি বাগান রয়েছে। বাগান মালিকরা জানান, চা শিল্প এখন এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অতিরিক্ত খরতাপ, অনাবৃষ্টি, উৎপাদিত চায়ের প্রকৃত মূল্য না পাওয়ায় বাগান মালিকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
এবার চা উৎপাদনের পিক সিজনে লোডশেডিং চা শিল্পে বিপর্যয়ের ঘণ্টা বাজাচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুত বিভাগ থেকে লোডশেডিংয়ের নির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করলেও ঘোষিত সময় মানা হচ্ছে না। হঠাৎ করে বিদ্যুত চলে যাচ্ছে। এতে জেনারেটর চালু করতে সময় লাগছে। আবার বিদ্যুত আসলে মেশিন নতুনভাবে চালু হতেও সময় লাগছে। এতে উৎপাদন প্রক্রিয়া ঢিলে হওয়ায় ধারাবাহিক প্রসেসিংয়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সময়ও নষ্ট হচ্ছে আবার চায়ের গুণগত মানও নষ্ট হচ্ছে।
বিদ্যুত চলে গেলে জেনারেটর চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় ডিজেল। যে কারণে জেনারেটার চালিয়েও উৎপাদন ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে ২৩টি দেশে চা রফতানি করা হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, জাপান, ভারত ও সুইজারল্যান্ড রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, চাজাত পণ্য থেকে সরকার ১৫ শতাংশ ভ্যাট নির্বিঘেœ আদায় করে। চায়ের সুদিন ফিরিয়ে আনতে হলে মালিক, শ্রমিক পক্ষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। অকশনে যে চা বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা; বাজারে ভোক্তার কাছে সেই চা বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা। মূল্যের এই তারতম্য কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়া, চা-বোর্ডকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে না রেখে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। কৃষি পণ্যের মতো সারের ভর্তুকি ও কৃষি ঋণ দিতে হবে।
আন্দোলনে অচল চা বাগান ॥ চা শ্রমিকরা বলছেন, বর্তমানে তাদের মজুরি হচ্ছে ১২০ টাকা। এ মজুরি ‘অন্যায্য’, ‘অযৌক্তিক’। তাই মজুরি ৩০০ টাকায় উন্নীত করার দাবি নিয়ে তারা আন্দোলনে নেমেছেন। অপরদিকে মালিক পক্ষ বলছে একজন শ্রমিক দৈনিক প্রায় ৪০০ টাকা সমপরিমাণ সুবিধা পান। তারা বলছেন, ‘বাংলাদেশের চা শিল্প বর্তমানে বিশ্ববাজারে প্রভাব বিস্তার করছে। এরকম সময়ে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে এই খাতের ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বাজারকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। ‘এ শিল্প সবসময় শ্রমিক কল্যাণমুখী ছিল, এখনও আছে।
মজুরির বাইরেও শ্রমিকদের বিভিন্ন খাতে ভাতা দেয়া হয়ে থাকে। যেসব সুবিধা যোগ করলে এ খাতের শ্রমিকদের দৈনিক ৪০০ টাকার সমপরিমাণ মজুরি দাঁড়াবে।’ বাংলাদেশ টি এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাগানে শ্রমের দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবি করা হচ্ছে। বর্তমানে একজন শ্রমিক দৈনিক প্রায় ৪০০ টাকা সমপরিমাণ সুবিধা পান।
প্রত্যক্ষ সুবিধার মধ্যে দৈনিক মজুরি ছাড়াও ওভারটাইম, বার্ষিক ছুটি ভাতা, উৎসব ছুটি ভাতা, অসুস্থজনিত ছুটি ভাতা, ভবিষ্যত তহবিল ভাতা, উপস্থিতি ভাতা এবং ভবিষ্যৎ তহবিলের ওপর প্রশাসনিক ভাতার মাধ্যমে মোট গড়ে দৈনিক মজুরির প্রায় দ্বিগুণ অর্থ দেয়া হয়ে থাকে। তারা বলছেন, ‘চা বাগানের শ্রমিকদের সামাজিক উন্নয়ন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য দৈনিক ১৭৫ টাকার বিভিন্ন রকম সুবিধা দেয়া হচ্ছে।’
ধর্মঘট স্থগিতের আহ্বান প্রত্যাখ্যান ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা হবিগঞ্জ থেকে জানান, জেলার চা বাগানগুলোতে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে শ্রীমঙ্গলে আসেন শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী। তিনি ধর্মঘট স্থগিত করে আলোচনায় বসার আহ্বান জানালে চা শ্রমিক ইউনিয়ন তা প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়।
এদিকে বুধবার বিকেলে ঢাকায় মজুরি নিয়ে বসে কথা বলেন সরকার, মালিক ও শ্রমিক পক্ষ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল বুধবার জানান, আলোচনার জন্য ঢাকায় বসা হবে। সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু শ্রমিকরা আন্দোলনের যে পর্যায়ে আছেন, সেখান থেকে ফেরা কঠিন। তৃণমূল পর্যায়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, সেখান থেকে মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা আসা ছাড়া ফেরা যাবে না।