সেহেরা আহমেদী হুসনা
টানা ছত্রিশ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় অবশেষে নিজভূমের ফ্লাইটে ওঠার সুযোগ পেলেন আফগান তরুণী সেহেরা আহমেদী হুসনা (২৪)। শনিবার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিনি বিমানের দুবাইগামী ফ্লাইটে ওঠার সুযোগ পান। তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকা ছাড়ার আগে তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে প্রকাশ করেন তার প্রতিক্রিয়া- সারাজীবন মনে থাকবে এ ঘটনা। আগের রাতে যেভাবে অপমানিত হয়েছিলাম, আজ তার বিপরীতে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিলাম। নাউ আমি হ্যাপি। আই সেলুট বিমান এ্যান্ড ইউ অল।
ফ্লাইটে ওঠার আগে এভাবে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন চব্বিশ বছর বয়সী এই আফগান তরুণী। তিনি চরম স্বস্তি প্রকাশ করেন এজন্য যে, শনিবারই ছিল তার ভিসার মেয়াদ হওয়ার দিন। রাত বারোটায় তার ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। যদি দুর্ভাগ্যক্রমে শনিবার বিকেলের ফ্লাইট তিনি মিস করতেন, তাহলে আজ তাকে আরও খেসারত দিতে হতো। এজন্যই এটা তার কাছেও বিস্ময় ঠেকেছে।
ফ্লাইটে ওঠার পর চরম আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ভি চিহ্ন দিয়ে। সে ছবিও তার ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হয়েছে। তার প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়েছেন- বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান, বিমানের এমডি যাহিদ হোসেন, পরিচালক (গ্রাহক সেবা) মোঃ সিদ্দিকুর রহমান।
উল্লেখ্য, আগের রাতে দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফ্লাইট থেকে অফলোড হওয়ার পর চরম বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ায় তোলপাড় দেখা দিলে সবার টনক নড়ে। শুক্রবার দিনভর বিমানের কর্মকর্তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় শনিবার বিকেল সোয়া পাঁচটায় দুবাইগামী ফ্লাইটে উঠতে সক্ষম হন তিনি। এ ঘটনায় একদিকে যেমন বিমানের কিছু লোকের গাফিলতি ছিল তেমনি সমালোচনার মুখে দ্রুততম সময়ে পরবর্তী ফ্লাইটে তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করায় প্রশংসিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় এই এয়ারলাইন্সটি।
বিমান জানিয়েছে, যে কারণে হুসনাকে অফলোড করা হয়েছিল- বৃহস্পতিবার রাতে সেটার একটা গ্রাউন্ড ছিল। বিমানের স্টেশন ম্যানেজার জাকির হোসেন জানান, ঢাকা থেকে আবুধাবী পর্যন্ত হুসনার টিকেট কনফার্ম ছিল। কিন্ত আবুধাবী থেকে কাবুল পর্যন্ত অনওয়ার্ড কানেকশন ছিল না। এতে ঢাকায় বিমানের চেকইন কাউন্টারে তার বোর্ডিং কার্ড প্রিন্ট হচ্ছিল না।
এ অবস্থায় তাকে এখান থেকে ফ্লাইটে পাঠানোর কোন সুযোগ ছিল না। তার টিকেট কনফার্ম করার দায়িত্ব ছিল কাবুল থেকে যেই এজেন্সির মাধ্যমে অনলাইনে টিকেট কেটেছিল সেই কোম্পানির। এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে অফলোড হবার পর এই আফগানী যে বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছেন- তা বলতে গিয়ে তিনি আঁতকে উঠেছেন- তেমনি ছত্রিশ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় ফ্লাইটে উঠতে পেরে চরম তৃপ্তির হাসি হেসে ভি চিহ্ন প্রদর্শন করেন।
বিকেল সোয়া পাঁচটায় তিনি বিমানের দুবাইগামী ফ্লাইটে বসেই সে ছবি তুলে ঢাকা ও কাবুলের শুভাকাক্সক্ষীদের কাছে পাঠিয়েছেন। ফ্লাইট থেকে তিনি ধন্যবাদ ও অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিনিধি, বিমানের কেবিন ক্রু ফ্লোরা নাসরীন, জিএম আজিজুল ইসলাম, এয়ারপোর্টের স্যানিটারি ইনস্পেক্টর নুরুন্নবী টিপুসহ অন্যান্যদের।
বৃহস্পতিবার রাতে ফ্লাইট থেকে অফলোড হবার পর বিমানবন্দরে হুসনার কান্না দেখে দৈনিক জনকণ্ঠ প্রতিনিধি ফোন করেন পরিচালক গ্রাহক সেবা সিদ্দিকুর রহমান ও জিএম আজিজুল ইসলামের কাছে। তাদের তাৎক্ষণিক নির্দেশে সক্রিয় হয়ে ওঠেন শাহজাহান ও অন্যরা। রাতে মেয়েটিকে বিমানবন্দরের ওয়েলফেয়ার রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাবার প্রদানসহ সেবাশুশ্রƒষা করেন কেবিন ক্রু ফ্লোরা নাসরীন, স্যানিটারি ইনস্পেক্টর নুরুন্নবী টিপু, বেবিচক জনসংযোগ কর্মকর্তা সোহেল কামরুজ্জামান ও এ প্রতিনিধি। খবর পেয়ে রাতেই তাকে এয়ারপোর্ট থেকে বনানীর ডরমিটরিতে নিয়ে যান এশিয়ান ইউনির্ভার্সিটির ফর ওমেন-এর প্রতিনিধিরা।
পরদিন শুক্রবার দিনভর বিমানের স্টেশন ম্যানেজার জাকির হোসেন ঢাকা-আবুধাবিতে যোগাযোগ করেন। কিন্তু তার ট্রানজিট ভিসা না থাকায় সে রুট্ পরিবর্তন করে ঢাকা-দুবাই হয়ে কাবুলের টিকেট ইস্যু করে বিমান। দুবাই থেকে কাবুল পর্যন্ত কাম এয়ারের টিকেট সংগ্রহ করে দেন অনলাইনেই মেয়েটির ছোটভাই। শুক্রবার রাতে জাকির হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করার পর মেয়েটি কিছুটা স্বস্তি ফিরে পান। শনিবার দুপুর একটায় বিমানবন্দরে সবার আগেই তার চেকইন করে দেন সাজ্জাদ হোসেন। বোর্ডিং কার্ড হাতে পেয়ে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় কেঁদে ওঠেন। তাৎক্ষণিক তিনি ছুটে যান ইমিগ্রেশনে। তবে যেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল সেটা ঘটেছে ইমিগ্রেশনে। তার পাসপোর্ট ও ভিসা দেখে ডেস্ক কর্মকর্তা জানান- জটিলতা রয়েছে।
এটা মেয়েটি এ প্রতিনিধিকে ইশারায় জানালে একজন পরিদর্শকের সহায়তা চাওয়া হয়। তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভেতরের অপর এক উর্ধতন ইমিগ্রেশন কর্তার কাছে। সেখানে আগের দুদিনের কাহিনী বলার পর তার বিষয়টি মানবিক কারণে সুবিবেচনা করে ক্লিয়ারেন্স দেয়া হলে মুহূর্তেই সিল মারা হয়। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্পাইস রেস্টুরেন্টে। সেখানে সামান্য ফ্রুটস, সালাদ আপ্যায়ন করে নিয়ে যাওয়া হয় ফ্লাইটে। এভসেক কর্মকর্তা হুমায়ুন তাকে নিয়ে যান ফ্লাইট পর্যন্ত। ফ্লাইট টেকঅফ করার আগমুুহূর্তে তার এই ছত্রিশ ঘণ্টার বিপর্যয়কর কাহিনী বর্ণনা করলেও শেষ বিজয়ের তৃপ্তির হাস্যমুখে ভি চিহ্ন প্রদর্শন করেন্। সেটাই ভাইরাল হয়ে গেছে ঢাকা থেকে কাবুল।
জানা গেছে- হোসনা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের মেয়ে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের চব্বিশ বছর বয়সী এই মেয়ে মাস চারেক আগে বাংলাদেশে আসে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর ওমেনে- উচ্চশিক্ষা নিতে। কিছুদিন পড়াশোনা করার পর এখানকার খাবারদাবার ও পরিবেশের কারণে তার পেটে জটিল ব্যাধি দেখা দেয়। আবার চোখের কর্নিয়াও নষ্ট হয়ে যায়। এসব কারণে তিনি ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ গুটিয়ে আফগান ফিরে যাবার জন্য টিকেট কাটেন বিমানের। তারপরই ঘটে যায় বিপত্তি।