
ডাকাত চক্রের দশ সদস্য
দিনে বাসের হেলপারি, রাতে ডাকাতি করেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী রতন হোসেন। মাত্র ২১ বছর বয়সী রতন পেশায় বাসের হেলপার। দিনে বাসচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করলেও রাতের আড়ালেই ছিল রতনের ভিন্ন রূপ। রাতে বিভিন্ন বাসে ডাকাতি করতেন রতন। এর আগেও ১০টি বাসে ডাকাতির নেতৃত্ব দেন তিনি। গ্রেফতার হয়ে কারাভোগও করেছেন। সাভারে রোড ব্লক করে একটি বাস ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার হন রতন। প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে ২০২০ সালে আবারও ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েন। সবশেষ টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় রতনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
সোমবার কাওরান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলন্ত বাসে ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ছিলেন ১৩ জন। তাদের কেউ বাসের হেলপার, কেউবা পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। এ ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী রতনসহ ডাকাত চক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। রবিবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জে অভিযান চালিয়ে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা, র্যাব-১২ ও র্যাব-১৪ তাদেরকে গ্রেফতার করে।
বাসে ডাকাতির পরিকল্পনা থাকলেও ধর্ষণের কোন পরিকল্পনা আগে থেকে ছিল না ডাকাতদের।গ্রেফতাররা হলেন- ডাকাত চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী রতন হোসেন (২১), মোঃ আলাউদ্দিন (২৪), সোহাগ ম-ল (২০), খন্দকার হাসমত আলী ওরফে দীপু (২৩), বাবু হোসেন ওরফে জুলহাস (২১), মোঃ জীবন (২১), আব্দুল মান্নান (২২), নাঈম সরকার (১৯), রাসেল তালুকদার (৩২) ও আসলাম তালুকদার ওরফে রায়হান (১৮)। অভিযানে তাদের কাছ থেকে ২০টি মোবাইল সেট, রূপার চুড়ি ২টি, ১৪টি সিমকার্ড ও ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
তিনি বলেন, গত ২ আগস্ট দিবাগত রাত আনুমানিক ১টায় কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাস টাঙ্গাইল অতিক্রম করার সময় ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনায় এক যাত্রী বাদী হয়ে মধুপুর থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ১০/১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এর পর র্যাব জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। গ্রেফতার রতন মিয়া বাস ডাকাতির তিনদিন আগে তার সহযোগী রাজা মিয়াকে ডাকাতির প্রস্তাব দিলে তিনি অন্যদের একত্রিত করার কথা বলেন। পরে রতন, মান্নান, জীবন, দীপু, আউয়াল ও নূরনবীকে ডাকাতির পরিকল্পনার কথা জানান। এরপর মান্নান তার সহযোগী সোহাগ, আসলাম, রাসেল, নাঈম ও আলাউদ্দিনকে নিয়ে ডাকাতিতে যোগ দেন। এ ডাকাতিতে রতনের নেতৃত্বে মোট ১৩ জন অংশ নেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রতনের নেতৃত্বে গত ২ আগস্ট গাজীপুরের জিরানী বাজার এলাকায় সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বাসে ডাকাতির পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। মূল পরিকল্পনাকারী রতন এ ডাকাতি কাজে যাবতীয় প্রস্তুতির আর্থিক খরচ বহন করেন। চক্রের সদস্যদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে তাদের কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, রতন ২ আগস্ট রাতে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা মোড়ের একটি দোকান থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত ৪টি চাকু, ২টি ধারালো কাঁচি ও একটি ক্ষুর কেনেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাকাতির রাতে রাজাসহ চক্রের অন্য সদস্যরা সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। রাত আনুমানিক ১টার দিকে কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ঈগল পরিবহনের একটি বাস সিরাজগঞ্জ রোড মোড় এলাকায় পৌঁছলে রাজা বাসটিকে থামার সঙ্কেত দেন। এরপর যাত্রীবেশে প্রথমে রতন, রাজা, মান্নান ও নূরনবী বাসটিতে ওঠেন। পরে আরও দুই দফায় ডাকাতচক্রের অন্য সদস্যরা বাসটিতে যাত্রীবেশে ওঠেন। বাসটিতে ২৪ সাধারণ যাত্রী থাকায় ডাকাতচক্রের অধিকাংশ সদস্য বাসের পেছনের দিকে বসেন। বাসটি বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু এলাকা অতিক্রম করলে রতন ডাকাত দলের সদস্যদের চাকু ও ধারালো কাঁচি দেন। এ সময় ধূমপানের কথা বলে বাসের গেটের কাছে যান আউয়াল। তিনি অন্যদের ইশারা দিলে রাজা, রতন, মান্নান ও নূরনবী বাসচালকের সিটের কাছে গিয়ে ড্রাইভারকে মারধর করেন এবং রতন বাসের ড্রাইভিং সিটে বসে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেন।
ডাকাত দলের বাকি সদস্যরা বাসের চালক ও সুপারভাইজার, হেলপারসহ সাধারণ যাত্রীদের হাত-মুখ বেঁধে সিটকভার দিয়ে মুথ ঢেকে দেন। এরপর তারা যাত্রীদের সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ, স্বর্ণালঙ্কার ও মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেন। এছাড়া এক নারী যাত্রীকে ধর্ষণ করেন। পরে টাঙ্গাইলের হাটুভাঙ্গা মোড় হয়ে মধুপুরে যাওয়ার পথে মধুপুরের রক্তিপড়া এলাকায় লুট করা মালামাল নিয়ে ডাকাত দলের সদস্যদের মধ্যে বাগবিত-া হয়। সে সময় রতন গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এ অবস্থায় পেছনে তাকালে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে হেলে পড়ে। এরপর ডাকাতদলের সবাই লুটকৃত মালামালসহ বাস থেকে নেমে পালিয়ে যান।
র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, দুর্ঘটনার পর ডাকাতদল বাস থেকে নেমে পালিয়ে যায়? পরে অন্য বাসে করে ডাকাতচক্রের সদস্যরা টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় যান এবং মধুপুরের কুড়ালিয়া এলাকায় রতনের নিকটাত্মীয়ের ফাঁকা বাড়িতে গিয়ে লুণ্ঠিত মালামাল নিজেদের মধ্যে বণ্টন করেন। এরপর রতন গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় আত্মগোপন করেন। মান্নান, আলাউদ্দিন ও বাবু পৃথকভাবে আশুলিয়ার জিরানী বাজার এলাকায় আত্মগোপন করেন। এছাড়া আসলাম, নাঈম, রাসেল প্রথমে নিজের এলাকায় ও পরে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ এলাকায় আত্মগোপন করেন। ডাকাত জীবন কোনাবাড়ীতে আত্মগোপন করেন। ডাকাত দীপু প্রথমে টাঙ্গাইলের পিরোজপুর গ্রামে ও পরে গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকায় আত্মগোপন করেন।
ডাকাত সোহাগ প্রথমে জিরানী বাজার ও পরে জামালপুরে এবং পুনরায় জিরানী বাজারে আত্মগোপন করেন। গ্রেফতার রতন হোসেন ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারী। তিনি পেশায় গাড়ির হেলপার। তার বিরুদ্ধে আগেও ডাকাতির অভিযোগ রয়েছে। রতন ২০১৮ সালে নূরনবী, জীবন ও অন্য কয়েকজনকে নিয়ে রোড ব্লক করে সাভার পরিবহনের একটি বাসে ডাকাতি করেন। ওই ঘটনায় রতন গ্রেফতার হয়ে প্রায় দেড় বছর কারাভোগ করেন। পরে জামিনে বের হয়ে ২০২০ সালে আবার নূরনবী, জীবন ও আউয়ালকে নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি অটোরিক্সা ছিনতাই করেন। তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা জীবনকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার হয়ে রতন প্রায় এক বছর কারাভোগ করেন। কারাভোগের পর জামিনে বের হয়ে তিনি তার সিন্ডিকেট নিয়ে সাভার, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় মহাসড়কে আরও বেশ কয়েকটি ডাকাতি করেন।
এদের সম্পর্কে র্যাব জানায়, জীবন পেশায় গাড়ির হেলপার। এর আড়ালে তিনি বেশ কয়েকটি পরিবহন ডাকাতিতে অংশ নেন। ডাকাতিতে তিনি যাত্রীদের মালামাল লুটের দায়িত্বে ছিলেন। এর আগে ২০১৮ ও ২০২০ সালে দুটি ডাকাতির মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেন। মান্নান গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। তিনি ২০১৯ সালে আশুলিয়া থানায় করা একটি চুরির মামলায় কারাভোগ করেন। তার নেতৃত্বে আলাউদ্দিন, সোহাগ, বাবু, দীপু, রাসেল, রায়হান, নাঈম ডাকাতিতে অংশ নেন। তারা ঢাকা ও গাজীপুরের বিভিন্ন পোশাক করাখানায় চাকরি করতেন। তাদের সহযোগীদেরও ধরার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।