ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

সুরমা নদীর পানি সামান্য কমেছে, স্থিতিশীল কুশিয়ারা

সিলেট বিভাগে বন্যায় ৬৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ১ জুলাই ২০২২

সিলেট বিভাগে বন্যায়  ৬৪ লাখ মানুষ  ক্ষতিগ্রস্ত

বন্যাকবলিত অঞ্চল

নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নিদুদিন বাড়ার পর শুক্রবার সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমেছেপানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার বেলা ১২ টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে ৪ সেন্টিমিটার কমেছেতবে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে কুশিয়ারা নদীর পানি।  সিলেটে থেমে থেমে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছেতবে এই বৃষ্টিতে পানি বাড়ার শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের উপসহকারী প্রকৌশলী একেএম নিলয় পাশা।  এদিকে, টানা কয়েকদিনের বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জে নদ-নদীর পানি বাড়ছিলবন্যার শঙ্কাও ফের দেখা দিয়েছিলতবে শুক্রবার সুনামগঞ্জেও পানি কমেছে

বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল থেকে পানিও নেমেছে কিছুটা সুরমা নদীর পানি বৃহস্পতিবার বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিলশুক্রবার তা আরও নেমে ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বলেন, ভারতের মেঘালয়ে কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় এবং আমাদের সুনামগঞ্জেও বৃহস্পতিবার তেমন একটা বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সুরমা নদীর পানি কমতে শুরু করেছেবর্তমানে তা ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছেতবে উজানে যদি আবারও ভারি বৃষ্টিপাত হয় তাহলে নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত পুরো সিলেটদুই দফা বন্যায় বিভাগের চারটি জেলার লোকজন ক্ষতির মুখে পড়েছেনবিশেষ করে সিলেট নগরসহ জেলার ৮০ ভাগ এবং সুনামগঞ্জের ৯০ ভাগের ওপর এলাকা প্লাবিত হয়েছেবন্যার পানি দ্রুতগতিতে না কমায় বন্যার্ত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।  বানের পানিতে ভেসে গেছে ঘর-বাড়ি, গরু, মহিষ, হাঁস-মুরগিঅনেকে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিঃস্ব অবস্থায় বাড়ি ফিরে গেছেন।  আবহাওয়ার প্রতিকূলতা, থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় পানি ওঠা-নামা করছেএ অবস্থায় ঘরে ফেরা লোকজন আতঙ্কে রয়েছেনযেখানে এখন খাবার যোগাড় করা কঠিন সেখানে ঘর  তৈরি করে ঘুরে দাঁড়ানো  অসম্ভব

বন্যায় সিলেট বিভাগে সোয়া কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬৫ জনবিভাগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৬ লাখ ২২ হাজার ৯৬৮টি

সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সুনামগঞ্জের প্রায় ৩০ লাখ লোকসিলেট জেলা ও মহানগরে ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জন, মৌলভীবাজারে ২ লাখ ৬২ হাজার ৭৩৬ এবং হবিগঞ্জে ৮৩ হাজার ৪৯০ জন

৩০ জুন পর্যন্ত সিলেট জেলা প্রশাসনের বন্যা সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশনসহ ১৩ টি উপজেলা ও ৫ টি পৌরসভার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩ পরিবারমোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জনআর কাঁচা ঘরবাড়ি বন্যায় ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪০ হাজার ৯১টিসিলেট সিটি কর্পোরেশনসহ জেলায় ৬১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৫২ হাজার ৮৭৮ জন আশ্রয় নেনবৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৩৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৩৭ হাজার ১৭৬ জনপক্ষান্তরে বরাদ্দপ্রাপ্ত মোট ১ হাজার ৬১২ মেট্রিক টন চাল, ২০ হাজার ২১৮ প্যাকেট শুকনা খাবারের মধ্যে ১৯ হাজার ৯১৮ প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছেনগদ এক কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বরাদ্দকৃত ৬৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আহসানুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন

সুনামগঞ্জ ॥  ৪টি পৌরসভা ও ১১টি উপজেলা এবং ৮৮টি ইউনিয়নের সব কটি প্লাবিত দেখিয়েছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখাপানিবন্দী ৫৫ হাজার ৬৬০ পরিবার এবং জনসংখ্যার ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেনজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোঃ শফিকুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণকৃত ত্রাণের পরিমাণ ১ হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টননগদ ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকাবর্তমানে চালের মজুদ নেইবিতরণকৃত শুকনো খাবার ২৩ হাজার প্যাকেটএছাড়া ২৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫৩ হাজার ১০০ জন রয়েছেনএর মধ্যে পুরুষ ২১ হাজার, মহিলা ২০ হাজার, শিশু ১১ হাজার ৫০০ এবং প্রতিবন্ধী শিশু ৬০০ রয়েছেনজেলায় দুর্গতদের সহায়তায় ১২৩টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে

হবিগঞ্জ ॥  জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন শাখা সূত্র জানায়, বন্যায় ৬১৭ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়ে ২৪ হাজার ২৩০টি পরিবার এবং ৮৩ হাজার ৪৯০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেনঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭০টি।  জেলায় ৩৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৯ হাজার ৩৪৫ আশ্রিতদের মধ্যে বর্তমানে আট হাজার ১৯০ পুরুষ, আট হাজার ১৪ নারী, পাঁচ হাজার ১১ শিশু এবং ২০৪ প্রতিবন্ধী রয়েছেনপক্ষান্তরে ৮০০ মেট্রিকটন চাল, ৪০ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা, ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৩১ হাজার ৪১৬ ডানো শিশু খাদ্যের জন্য বিতরণ করা হয়

মৌলভীবাজার ॥  জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানান, বন্যায় ৫৮ হাজার ৫৯৫ পরিবার এবং ২লাখ ৬২ হাজার ৭৩৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেনএছাড়া ১৪ হাজার ৩০৯টি কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছেপক্ষান্তরে জেলায় ৮০৫ মেট্রিক টন চাল, ১৭শপ্যাকেট শুকনা খাবার, ৪৫ লাখ ৫৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছেএখনও ১৪৮ টন চাল, ২৫ লাখ টাকা ও ৩ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার রয়েছে

সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছেযাতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঘরবাড়ি নির্মাণ, মেরামতে প্রয়োজনীয় অনুদান পেতে পারেন

পানি কিছুটা কমার পর আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঘরে ফিরে যাচ্ছে মানুষপ্রতিনিয়ত ভানবাসি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন পানি বাহিত রোগেবিশেষ করে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনকপ্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেনতবে এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি।  সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে বন্যায় তলিয়ে আছে টিউবওয়েল ও নলকূপগুলোবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যায় তলিয়ে যাওয়া টিউবওয়েলের পানি ও বন্যার পানি পান করায় বাড়ছে পানি বাহিত রোগীর সংখ্যা

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মহিলা ও শিশু ওয়ার্ডে একটি সিটও খালি নেইরোগীদের চাপে পুরুষ ওয়ার্ডে শিশুদের ভর্তি করা হচ্ছে।  বন্যার পর পানি বাহিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী পারভেজ খান জানান, এখন পর্যন্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৫৫ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু মহাসড়কে গাড়িতে করে বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করা হচ্ছেএছাড়া বন্যার পানি থেকে জেগে ওঠা টিউবওয়েলগুলোকে জনবল অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট করা হচ্ছেতিনি আরও জানান, একটি এনজিও থেকে ২০টি টিউবওয়েলের ট্রিটমেন্ট করবেন বলে তারা আমাদেরকে জানিয়েছেন

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার কামরুজ্জামান জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীর বেশিরভাগ ডায়রিয়ায় আক্রান্ততাদেরকে আমরা নিয়মিত চিকিসা দিচ্ছিএছাড়া উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় আমাদের মেডিক্যাল ক্যাম্প করা হচ্ছেবন্যা আসার পর থেকে ৩০ টির বেশি মেডিক্যাল ক্যাম্প করা হয়েছেএখনও এগুলো চলমান রয়েছেকোম্পানীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার পিস ওআরএস বিতরণ করা হয়েছেআরও ২ লাখ পিস ওআরএস অর্ডার করা হয়েছেতিনি আরও জানান, আমাদের ৬ টি ইউনিয়নই প্লাবিতবন্যার পানি কমার পর রোগীর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারেতবে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছেতিনি বন্যা কবলিত এলাকার বাসিন্দাদের প্রতি বিশুদ্ধ পানি পান করার পরামর্শ দেন

হবিগঞ্জে সড়কের ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি নিজস্ব সংবাদদাতা হবিগঞ্জ থেকে জানান, বন্যার পানিতে হবিগঞ্জের সড়কগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেপানি কমতে শুরু হওয়ার পর সড়কগুলোর ক্ষতির চিত্র ভেসে উঠেছেবন্যাকবলিত এ জেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রমহবিগঞ্জে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) আওতাধীন সড়ক রয়েছে ২ হাজার ১৬৫ কিলোমিটারএর মধ্যে ৪০২ কিলোমিটার বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেআর্থিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার অধিক

কুড়িগ্রামে পানিবন্দী ৫০ হাজার মানুষ স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রামে দ্বিতীয় দফায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ৫০ হাজার মানুষপ্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিতীয় দফায় বন্যার কবলে পড়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষেরএসব এলাকার রাস্তা-ঘাট তলিয়ে থাকায় ভেঙ্গে পড়েছে যাতায়াত ব্যবস্থাঅন্যদিক পর পর দুদফা বন্যার কবলে পড়ায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্ল্যাহ আল মামুন জানান, উজানে ভারি বৃষ্টির ফলে কুড়িগ্রামে ধরলা ও দুধকুমারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছেভাটিতে পানি কম থাকায় নদ-নদীর পানি হ্রাস পেতে শুরু করেছে

×