ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

"বনায়ন" প্রকল্পের চেষ্টায় লালন শাহ সেতুতে সবুজের সমারোহ

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ১২ নভেম্বর ২০২০

ফিরোজ মান্না ॥ বছর কয়েক আগেও পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলা সংযোগকারি লালন শাহ সেতুর দুই পার ছিল ধু ধু মরুভূমি। আশপাশে ছিল না কোন গাছ পালা। নদীর বালি ড্রেজিংয়ের ফলে তৈরী হয়েছিল ধূসর বালুর মাঠ। দেখে মনে হত মানব সৃষ্ট এক মরুভূমি। নদীর দুই পাড়ে একসময় যে সবুজালয় ছিল তা কেবলই লোক গল্প হয়ে উঠেছিল। বালির ভারি স্তরের কারণে নতুন করে জন্মাতো না কোন গাছ গাছালি। যার ফলে সবুজের চিহ্ন মাত্র ছিল না নদীর আশপাশের এলাকায়। মরুর মতো এই ভূমিকে আবারও সবুজে রুপান্তরিত করতে মেধা আর শ্রম দিয়ে অক্লান্ত চেষ্টা শুরু করে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) এর 'বনায়ন' প্রকল্প। ২০০৫ সালে 'বনায়ন' প্রকল্পের আওতায় বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল। আর এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে লালন শাহ সেতুর দুই পাড় ও আশপাশের এলাকা সবুজায়নের জন্য প্রায় ২৩ হাজার চারা গাছ লাগানো হয়। তবে সাধারন মাটিতে যেভাবে গাছ বেড়ে উঠে, এখানে সেটি সম্ভব হয়ে উঠেনি। বরং প্রতিনিয়ত পানির সরবরাহ রাখতে হতো। সাধারণত বালির উপর শেকড় গজাতে চাইতো না। 'বনায়ন' এর অদম্য কর্মীরা হাল ছাড়লেন না। গাছ গুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে নতুন নতুন উপায় অবলম্বন করলেন। এক সময় সেতুর দু'পাড়ে ফিরে আসে সবুজের সমারোহ। ফলে ধূসর মরু মাঠ সাজে প্রকৃতির নতুন রূপে। দীর্ঘ সময় ধরে পরিকল্পনা ও পরিচর্যার ফলে সাফল্যের মুখ দেখেছে প্রকল্পটি। লালন শাহ সেতুর 'বনায়ন' প্রকল্পে সরাসরি কাজ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ সামাদ মিয়া। তিনি বলেন, "একটা সময় ছিল যখন সেতুর দুই পাড় ছিল ধবধবে সাদা। কিন্তু 'বনায়ন' প্রকল্প আসার পর সে চিত্র পালটে গেছে। নদীর দুই পাড় আস্তে আস্তে সবুজ হওয়া শুরু করে।" তিনি আরও জানান, "বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বড় অসুবিধা ছিল পানির দুস্প্রাপ্যতা। চারপাশে বালির কারণে গাছে যথা সময়ে পানি দেওয়া নিয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। শুরুতে গাছ টিকিয়ে রাখাটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। পরবর্তীতে বেশ কিছু পানির পাম্প স্থাপনের মাধ্যমে প্রতিটি গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ করা হয়। প্রথম দিকে মাটি ও কম্পোস্ট এর মিশ্রণ বেশ দূরের থেকে বহন করে আনা হত, আর বৃত্তাকারে প্রতিটি গাছের গোড়ায় যোগ করা হত। এছাড়াও, সেই সময় আমরা নিশ্চিত করেছিলাম যাতে প্রাকৃতিকভাবে ঝরে পড়া গাছের পাতাগুলো খুব ভালভাবে মাটির সাথে মিশে যায় যা জৈব সার হিসেবে কাজ করত। একটা সময় এখানকার মাটির গঠনে বেশ ভালো একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল; এখন এই মাটি এতটাই উর্বর যে যেই গাছই লাগানো হোক না কেন, তা খুব ভাল হয়। দেশের সর্ববৃহৎ সিএসআর প্রকল্প 'বনায়ন' এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০ সালে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই প্রকল্পটির পথচলা। সবুজায়নের লক্ষে লালন শাহ সেতুর মত দেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন; চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কুষ্টিয়ার জি কে ক্যানেল, যমুনা সেতু সংলগ্ন বনায়ন প্রকল্প, বান্দরবানের লামা-আলীকদম প্রকল্প, কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক, পদ্মা সেতু সংলগ্ন এলাকা, রোহিঙ্গ্যা ক্যাম্প, ভাষানচর, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সবুজ দেশ গড়ার প্রকল্পে সহযোগী হিসেবে বনায়ন কাজ করছে বিজিবি, বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস, প্যারা মিলিটারি ফোর্সেস ও আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে। ‘বনায়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানান সময় সরকারি ও বেসরকারি অনেক সহযোগী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান কাজ করে আসছে। তেমনি ভাবে লালন শাহ সেতুর প্রকল্পেও সম্পৃক্ত ছিল বাংলাদেশ সরকারের সেতু বিভাগ। লালন শাহ সেতু ও আত্রাই টোল অপারেশন প্রজেক্ট এর অপারেশন ডিরেক্টর মোঃ আতিকুল হাসান বলেন, "বনায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিএটি বাংলাদেশ লালন শাহ সেতুর দুইপাশে ও পদ্মা নদীর তীরে যে বনায়ন করেছে তা পরিবেশের সুরক্ষার পাশাপাশি সংলগ্ন এলাকাসমূহের উল্লেখযোগ্যভাবে সৌন্দর্যবর্ধন করেছে। কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যেই অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টার মাধ্যমে বালুময়-মরুভূমিসম একটি স্থানকে সবুজে সুসজ্জিত করেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।" এছাড়া 'বনায়ন' এর এই বিশেষ প্রকল্পের পরিকল্পনায় তথা বৃক্ষ প্রজাতি চয়ন ও রোপনের নকশা তৈরী ইত্যাদি কাজে বাংলাদেশ সরকারের বন অধিদপ্তর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। কুষ্টিয়ার সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (উপ-বন সংরক্ষক) ছালেহ মো: শোয়াইব খান বলেন, "পরিবেশের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগের পাশাপাশি বিএটি বাংলাদেশের 'বনায়ন' প্রকল্পটি গত ৪০ বছর ধরে দেশের সবুজায়নে এক অনন্য অবদান রেখে আসছে, যা বেসরকারিভাবে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। কুষ্টিয়া জেলার বেশ কয়েকটি স্থানে সুপরিকল্পিত 'বনায়ন' কর্মসূচির নমুনা পাওয়া যায়, যা সকলের কাছে ব্যপকভাবে প্রশংসিত। লালনশাহ সেতুর পূর্ব পাড়ে তাদের 'বনায়ন' বৃহৎ পরিসরে সবুজায়নের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। 'বনায়ন' প্রকল্পের আওতায় যেসকল স্থানে বৃক্ষরোপন করা হয়েছে সেগুলো টেকসই করার লক্ষ্যে উদ্দ্যোগ নেয়া যেতে পারে।" ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সহযাত্রী হিসেবে কাজ করছে 'বনায়ন'। পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি এই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে আর্থিক ভাবেও লাভবান হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা। পাশাপাশি এবছর মুজিব বর্ষকে কেন্দ্র করে বনায়নের আওতায় ৫৫ লক্ষ চারা বিতরণ করা হয়েছে। দীর্ঘ এই ৪০ বছরের প্রচেষ্টার স্বীকৃতি স্বরূপ ৪ বার প্রধানমন্ত্রী থেকে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক স্বীকৃতি অর্জন করেছে 'বনায়ন'।
×