
মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জে স্কুল শিক্ষকের পর এবার মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল-আমিনের বিরুদ্ধে ১২ শিশু ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়নের ভুঁইঘরের মাহমুদপুর পাকা রাস্তা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বৃহ¯পতিবার বেলা এগারোটায় র্যাব-১১ সদস্যরা মাহমুদপুর বায়তুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল-আমিনকে গ্রেফতার করে। এদিকে মাদ্রাসার শিক্ষক আল-আমিনের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে এলাকাবাসী। এ সময় তারা ওই শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে নানা ধরনের স্লোগান দেয়। গত বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসা থেকে মাত্র ২ হাজার গজ দূরে সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি কান্দাপাড়ার অক্সফোর্ড হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক আরিফুল ইসলামকে ২০ শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করে র্যাব-১১ সদস্যরা। ওই শিক্ষককে আশ্রয়প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগে অক্সফোর্ড স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জুলফিকারকেও গ্রেফতার করা হয়।
জানা যায়, ২০১৫ সালে ফতুল্লা থানার কুতুবপুর ইউনিয়নের ভুঁইঘরের মাহমুদপুর পাকা রাস্তা এলাকার বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষক মাওলানা আল-আমিন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্কুলে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর কথা বলে শিশু ছাত্রীদের নানাভাবে ব্ল্যাকমেল করে, আবার কোন শিক্ষার্থীর ছবি নিয়ে পর্নোগ্রাফি নায়িকার মাথা কেটে শিক্ষার্থীর মাথা বসিয়ে দিয়ে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হবে বা বাবা-মাকে দেখিয়ে দেবে এমন ভয়ভীতি দেখিয়ে শিশুশ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণীর একাধিক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থা করে আসছিল পাষ- এই শিক্ষক। মাদ্রাসায় প্লেগ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা নুরানী, নাজেরা, হিফজুল ও কোরান বিভাগে লেখাপড়া করতে আসে। মাদ্রাসাটি একটি টিনশেড ভবনে অবস্থিত।
র্যাব জানায়, গত ২৭ জুন সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি কান্দাপাড়া অক্সফোর্ড হাই স্কুলের শিক্ষক আরিফল ইসলাম ২০-২৫ শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার হয়। ওই ঘটনার গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিনের ফেজবুক পেজে আপলোড করে। পরে মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী মা শিক্ষার্থীর পাশে শুয়ে ফেজবুকে ওই সংবাদটি দেখছিল। তখন পাশে শুয়ে থাকা ওই ছাত্রী তার মাকে বলে, মা অক্সফোর্ড স্কুলের শিক্ষক গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু আমাদের মাদ্রাসার হুজুরকে কেন গ্রেফতার করা হয় না। এ কথা শুনে শিশুর মা জানতে চায়, কেন? কি হয়েছে? তখন ওই শিক্ষার্থী তার মাকে জানায়, হুজুর অনেক মেয়েকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছেন, একাধিক শিক্ষার্থীকে বছরের পর বছর যৌন হয়রানি করে আসছে। পরে বিষয়টি ওই শিক্ষার্থীর অভিভাবক মা র্যাবকে জানায়। র্যাব অনুসন্ধানে নেমে জানতে পারে, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মাওলানা আল-আমিন ১০ থেকে ১২ ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে র্যাব অভিযান চালিয়ে শিক্ষক আল-আমিনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার আল-আমিন কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ভুঁইয়াপাড় এলাকায় বাড়ি।
র্যাব-১১ এর অধিনায়ক (সিও) কাজী শামসের উদ্দিন চৌধুরী জানান, আমরা জানতে পারি এ মাদ্রাসার শিক্ষক আল-আমিন পড়তে আসা একাধিক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। আমরা নির্যাতনের শিকার ১২ ভিকটিমের খোঁজ পেয়েছি। শিক্ষক আল-আমিনের স্ত্রী একজন পর্দানশীন নারী হওয়ায় তিনি মাদ্রাসার পেছনের ঘরে বসবাস করেন। ওই শিক্ষক তার স্ত্রীর অবর্তমানে প্রাইভেট পড়ানোর কথা বলে, নানা কৌশল অবলম্বন করে, আবারও কাউকে ব্ল্যাকমেল করে, পর্নোগ্রাফি নায়িকার ছবির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ছবি জুড়ে দিয়ে একাধিক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থা করে এ শিক্ষক। তিনি বলেন, শিক্ষকের যৌন হেনস্থার অনেক প্রমাণ তার ডেক্সটপ কম্পিউটারে পাওয়া গেছে। কম্পিউটারটি র্যাব জব্দ করেছে। র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আলেপ উদ্দিন জানান, আটক শিক্ষক আল আমিনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, কোন শিক্ষার্থীর অভিভাবক চাইলে ফতুল্লা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করতে পারবে।
অভিযুক্ত শিক্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি ॥ বাইতুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসায় শিক্ষক কর্তৃক শিশু ছাত্রীদের যৌন নির্যাতনের খবর পেয়ে মিজমিজি, কান্দাপাড়া, সানারপাড়, মামুদপুর ও ভূঁইঘরসহ আশপাশের নারী-পুরুষরা ভিড় করে। এ সময় অভিযুক্ত শিক্ষক মাওলানা আল-আমিনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তারা বলছেন, ভাল মানুষের বেশ ধরে শিক্ষক আল-আমিন যে অপকর্ম করেছে আমরা তার কঠিন শাস্তি চাই। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এমন অপকর্ম করার সাহস না পায়। একই এলাকার বাসিন্দা আলী হোসেন জানান, যদি ওই শিক্ষক শিশু ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন করে থাকেন তবে তার আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। একটি টিনশেড ভবন ভাড়া নিয়ে মাদ্রাসা করা হয়েছে। এগুলো অনুমোদন না নিয়েই যত্রতত্র করা হয়েছে। তবে মাদ্রাসার ভেতরে কেউ যেতে পারে না। মাদ্রাসার ভেতরে কি হয় তা আমরা জানতে পারি না। একই এলাকার বাসিন্দা সাবিক হোসেন জানান, এ শিক্ষক আগে একটি টিনশেড মসজিদের ইমামতি করতেন। দু’বছর হলো মাদ্রাসা দিয়েছেন। এ শিক্ষক এ ধরনের কাজ করতে পারে তা আমাদের বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছে। আমরা তাদের তো উপরে উপরে ভালই দেখেছি। যদি এ শিক্ষক কোমলমতি শিশু ছাত্রীদের সঙ্গে এ ধরনের জঘন্যতম কাজ করে থাকে তবে আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। এ বিষয়ে কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু বলেন, মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাটি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও ঘৃণিত কাজ। ঘটনাটি একদিনে ঘটেনি। বহু আগ থেকে চলে আসছিল। আমরা এ এলাকার মাদ্রাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করব। যাতে এ ধরনের কোন ঘটনা আর ঘটতে না পারে।