
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্ক যেন এক দীর্ঘ বৈরিতার নাম। আধিপত্য বিস্তার, কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় তাদের দ্বন্দ্ব আজ গোটা বিশ্বের জন্য এক অস্থিরতার উৎস। অথচ ইতিহাস বলছে, এই দুই পরাশক্তি এক সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই রক্তক্ষয়ী দিনে, আদর্শগতভাবে বিপরীত হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন একত্র হয়েছিল একটি অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে—জার্মানিকে পরাজিত করা।
কিন্তু সেই কৌশলগত মিত্রতা ছিল কেবল সময়ের দাবি। যুদ্ধ শেষ হতেই বেরিয়ে আসে গভীর দ্বন্দ্ব। একদিকে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক সোভিয়েত ইউনিয়ন—দু’টি বিপরীত আদর্শের সংঘাত তখন থেকেই রূপ নিতে থাকে পরস্পরবিরোধিতায়।
শান্তির পর শুরু ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই শুরু হয় আরেক ‘যুদ্ধ’—যেটা ছিল না বারুদের, কিন্তু ছিল রাজনীতির, প্রযুক্তির, অর্থনীতির ও অস্ত্র প্রতিযোগিতার। বিশ্বে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ নামে পরিচিত এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানের মতো দেশগুলো রূপ নেয় এই দুই পরাশক্তির ছায়াযুদ্ধের ময়দানে।
অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে মহাকাশ জয়ের পালা, সবখানেই একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল তারা। গোয়েন্দা কার্যক্রম, প্রোপাগান্ডা, সামরিক জোট গঠন—দ্বন্দ্বের পরিধি ছিল ব্যাপক।
সোভিয়েত পতনের পরও শান্তি আসেনি
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেকে ভেবেছিলেন, সম্ভবত শেষ হলো দীর্ঘদিনের ঠান্ডা যুদ্ধ। রাশিয়া তখন সমাজতন্ত্রের ছায়া সরিয়ে পুঁজিবাদের পথে হাঁটার ঘোষণা দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তখন চাইল তার একক বিশ্ব নেতৃত্ব বজায় রাখতে।
পূর্ব ইউরোপের একের পর এক দেশ যুক্ত হয় ন্যাটোতে। রাশিয়ার চোখে এটি ছিল পশ্চিমাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ। তারা মনে করে, ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণ রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
রাশিয়ার ঘুরে দাঁড়ানো ও পুতিনের আগ্রাসন
রাশিয়ার পুনরুত্থান শুরু হয় ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে। সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার নেতৃত্বে রাশিয়া ঘোষণা দেয়, তারা আর পশ্চাৎপদ থাকবে না, বরং আবার বিশ্ব পরাশক্তির কাতারে ফিরবে। সেই লক্ষ্যেই শুরু হয় জর্জিয়ায় সামরিক অভিযান, ক্রিমিয়া দখল, এবং সর্বশেষ ইউক্রেনে আগ্রাসন।
আর প্রতিবারই রাশিয়ার সামনে এসে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। কখনো নিষেধাজ্ঞা, কখনো সামরিক সহায়তা, আবার কখনো কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করে ওয়াশিংটন।
আধুনিক যুদ্ধের নতুন রূপ
এই দ্বন্দ্ব এখন আর শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ, সাইবার হামলা, ভুয়া তথ্য প্রচার, ও সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগ—সব মিলিয়ে এক নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে ডিজিটাল ময়দানে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি এখন আর শুধুমাত্র ভূরাজনীতির লড়াই নয়—এটা বিশ্ব নেতৃত্বের প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের ব্যানারে বিশ্ব নেতৃত্ব দিতে চায়, আর রাশিয়া চায় বহুপাক্ষিক এক বিশ্ব ব্যবস্থা, যেখানে মার্কিন আধিপত্য থাকবে না।
বন্ধুত্ব ইতিহাস, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বর্তমান
সময়ের পরিক্রমায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই সাময়িক বন্ধুত্ব এখন কেবল ইতিহাসের পাতায়। বাস্তবতা হলো—যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া আজ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, যারা পরস্পরের শক্তিকে খর্ব করতে মরিয়া। কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো যুদ্ধের ময়দানে, আবার কখনো সামাজিক মাধ্যম বা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায়—এই লড়াই যেন চলছেই।
বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টালেও, এই দ্বন্দ্ব থেকে যায় চিরকালীন। যারা এক সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল হিটলারের বিরুদ্ধে, তারাই আজ দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি—নতুন কোনো যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে।
সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=xd29O39oacQ
রাকিব