ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ আগস্ট ২০২৫, ২২ শ্রাবণ ১৪৩২

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ইরান

প্রকাশিত: ১০:২২, ৬ আগস্ট ২০২৫; আপডেট: ১০:৩২, ৬ আগস্ট ২০২৫

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে ইরান

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে ইরান এখন একটি ব্যতিক্রমী ও শক্তিশালী নাম। মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত পারস্য উপসাগরীয় এই দেশটি কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞা ও রাজনৈতিক চাপে থেকেও নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে দৃঢ়তা ও কৌশলগত বুদ্ধিমত্তায়। কখনো সামরিক দক্ষতায়, কখনো কূটনৈতিক চালচালে আবার কখনো অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতায়—ইরান প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রমাণ করেছে তার অদম্যতা।

১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক শত্রুতা ও অবিশ্বাসের রূপ নেয়। সেই থেকেই একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে পশ্চিমারা। বিশেষ করে পরমাণু কর্মসূচি ঘিরে ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ২০১৫ সালে ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ (ইরান পরমাণু চুক্তি) স্বস্তি বয়ে আনলেও ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চুক্তি থেকে সরে গিয়ে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞাই যেন ইরানকে করেছে আরও আত্মনির্ভর। সীমিত সম্পদে নিজেদের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ইরান এখন নিজেই ড্রোন, হাইপারসোনিক ব্যালিস্টিক মিসাইল, যুদ্ধবিমান, রাডার সিস্টেম ও নৌযান তৈরি করছে। দেশের অভ্যন্তরে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য ভূগর্ভস্থ ‘মিসাইল সিটি’, সামরিক কারখানা ও পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, যেগুলো বাংকার বাস্টার বোমাও ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করেছে তেহরান।

দেশটির এলিট ফোর্স ‘ইসলামিক রেভোল্যুশনারি গার্ড’ শুধু একটি সামরিক বাহিনী নয়—বরং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ইরানের কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার প্রধান হাতিয়ার। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও গাজা অঞ্চলে ইরানের মিত্র মিলিশিয়া গোষ্ঠী—যেমন হিজবুল্লাহ, হুতি ও সাবির—এখন পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের (proxy war) গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞায় অর্থনীতি চরম চাপের মুখে পড়লেও ইরান বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। চীন, ভারত ও ভেনেজুয়েলার সঙ্গে শক্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলে তেল রপ্তানির বিকল্প বাজার তৈরি করেছে তারা। পাশাপাশি দেশীয় শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে বড় ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় কারখানায় এখন উৎপাদিত হচ্ছে নানা প্রযুক্তিপণ্য, কৃষিক্ষেত্রেও এসেছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

ক্রিপ্টোকারেন্সি ও বার্টার ট্রেডের মতো বিকল্প লেনদেন পদ্ধতিও ডলারনির্ভরতা কমাতে সাহায্য করেছে। প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বে বাধা থাকলেও বায়োটেকনোলজি, পরমাণু গবেষণা, মহাকাশ প্রযুক্তি ও ন্যানোপ্রযুক্তিতে ইরানের অগ্রগতি নজরকাড়া। ২০০৯ সালে নিজস্ব উপগ্রহ উৎক্ষেপণ এবং পরবর্তীতে মানুষবিহীন মহাকাশযান পাঠানোর মধ্য দিয়ে বিশ্বে প্রযুক্তির দৌড়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে দেশটি।

একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, ভেনেজুয়েলা ও কাতারের মতো দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে ইরান তার বহুপাক্ষিক কূটনীতির দিগন্তও প্রশস্ত করছে। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) এবং ব্রিক্সে অন্তর্ভুক্তির জন্য তেহরানের সক্রিয় প্রচেষ্টাও এর ইঙ্গিত বহন করে।

বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ইরানকে দুর্বল করেনি, বরং আত্মনির্ভরতার পথে ঠেলে দিয়েছে। প্রতিটি বাধাই যেন ইরানকে আরও দৃঢ়, আরও কৌশলী করে তুলছে। আর তাই আন্তর্জাতিক চাপ ও অবরোধের মাঝেও তেহরান জোর গলায় বলতে পারছে—নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইরানকে দমন করা যায় না।

 

সূত্র: https://www.youtube.com/watch?v=4_D5cCoBhvI

রাকিব

×