ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়া হাসপাতালে যন্ত্রপাতির মেয়াদ শেষ

উত্তরাঞ্চলে ক্যান্সার রোগী ৮ বছরে ৫ গুণ হয়েছে

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ১১ মে ২০১৯

 উত্তরাঞ্চলে ক্যান্সার রোগী ৮ বছরে ৫ গুণ হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনের দিক তাকালে চোখে পড়বে না। একটু এগুলেই, পেছনের দিকে অবস্থান বগুড়া মেডিক্যাল কলেজের অনকোলজি বা ক্যান্সার চিকিৎসা বিভাগ। তবে উত্তরাঞ্চলের ব্যস্ততম এই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (শজিমেক) সামনের অংশে ক্যান্সার বিভাগের অবস্থান না হলেও রোগীর চাপ হাসপাতালের অন্যান্য বিভাগের মতো সমানতালে বেড়েই চলছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে উত্তরাঞ্চলে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শজিমেকের রোগীর সংখ্যা পর্যালোচনা করে চিকিৎসকরা বলছেন, গত আট বছরে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণেরও বেশি। আর অতিরিক্ত রোগীর চাপে যে কোন সময় বন্ধ হওয়ার পথে শজিমেকের রেডিওথেরাপি মেশিন- লিনিয়ার এক্সিলিয়েটর (লাইনাক)। রেডিওথেরাপি মেশিনটির ইক্যুপমেন্ট লাইফ পার হয়েছে অনেক আগেই। তারপরেও নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি রোগীকে প্রতিদিন থেরাপি দিতে হচ্ছে পরিস্থিতি বিবেচনায়। ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসকসহ অন্য লোকবলের সঙ্কটও ক্রমান্বয়ে রোগীর সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। নতুন নতুন রোগীর চাপের কারণে রেডিওথেরাপি মেশিনটি যে কোন সময় বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকসহ কর্তৃপক্ষ। ক্যান্সার বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, আগামী ২ মাস অর্থাৎ জুলাই মাস পর্যন্ত রেডিওথেরাপির সিডিউল পূর্ণ রয়েছে। তারপরেও আসছে নতুন রোগী। এতে সিডিউল ঠিক রাখাসহ মেশিনটি চালু রাখা অসম্ভব অবস্থায় পৌঁছেছে। দ্রুত এর বিকল্প নতুন মেশিন স্থাপনসহ বর্তমান মেশিনের আপগ্রেডেশন না হলে এখানকার ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসা মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শজিমেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার মধ্যে ১৪টি জেলা থেকে ক্যান্সার আক্রান্তরা বগুড়ায় ক্যামো ও রেডিও থেরাপির চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। রাজশাহীর দুই জেলা বাদে বৃহত্তর রংপুরের সব জেলা ও সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা থেকে ক্যান্সারের থেরাপি নিতে রোগীরা এখানে আসছেন। বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে লিনিয়ার এক্সিলিয়েটর মেশিন ২০০৬ সালে সরবরাহ সময় ধরার পর এটি হাসপাতালে স্থাপন হযেছিল। আর এর মাধ্যমে ক্যান্সার চিকিৎসা শুরু হয় ২০১০ সালের এপ্রিলে। মেশিনটির স্থাপনের সময় ধরে এর ইক্যুপমেন্ট লাইফ ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছে। এর সেম্যুলেটর ব্যবস্থাও এখন অকার্যকর অবস্থায়। তার পরেও নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি রেডিও থেরাপি দিতে হচ্ছে। ক্যান্সার বিভাগের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলছেন, যেখানে প্রতিদিন ২০/২৫ জন রোগীর থেরাপি দেয়া সম্ভব সেখানে বর্তমান ভঙ্গুর অবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা রেডিওথেরাপি মেশিন দিয়ে ৩৫ জনেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ফলে যে কোন সময় এটি পুরো অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উত্তরাঞ্চলের মধ্যে এ ধরনের মেশিন শুধু বগুড়াতেই রয়েছে। রাজশাহী মেডিক্যালের মেশিনটি দীর্ঘ দিন নস্ট থাকার পর সম্প্রতি নতুন একটি কোবাল্ট ৬০ মেশিন চালু করা হলেও ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীরা বগুড়াতেই থেরাপি নিতে আসছে। কারণ সেখানে বিভিন্ন জটিলতার ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীদের চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ কম থাকায় এ অঞ্চলের ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের অন্যতম চিকিৎসা অবলম্বনের জায়গা হয়ে উঠেছে বগুড়া শজিমেক হাসপাতাল। শজিমেকের ক্যান্সার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ মোবাশ্বের-উর- রহমান জানান, তাদের কাছে যে রোগী আসছেন তা বেশির ভাগই এ্যাডভান্সড স্টেজের। প্রাথমিক পর্যায়ে আসলে সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তারপরেও তারা সাধ্যমতো রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী দেখা যায় বগুড়া শজিমেকে আসা প্রায় সব রোগীই উত্তরের জেলাগুলোর। আর গত দশ বছরের পরিসংখ্যান দেখলে পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, এ অঞ্চলে ক্যান্সার রোগীদের সংখ্যা বাড়ছে। শজিমেক হাসপাতালের তথ্যানুযায়ী ২০১০ সালে এখানে ক্যামোথেরাপি নেয় ৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ রোগী ছিল ৪৩ জন, মহিলা রোগী ৪৯ আর শিশু ছিল ৬ জন। এর পর থেকে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা শুধু বেড়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে ক্যামোথেরাপি নেয়া মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৭৫ জন। এতে পুরুষ রোগী ২৮৫, মহিলা ২৭২ ও শিশু ১৮। অপর দিকে ২০১০ সালে রেডিওথেরাপি নেয়া রোগী ছিল মোট ১০৬। সেখানে ২০১৮ সালে তা গিয়ে পৌঁছে ২৮২ জনে। শজিমেক ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, রেডিও থেরাপির মেশিনটি মাঝে মাঝে বন্ধ না হলে থেরাপির রোগীর এই সংখ্যা ২০১৮ সালে সাড়ে ৩ শতাধিক হতো। তবে থেরাপি হিসাব করলে এর সংখ্যা কয়েকগুণ। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্যান্সার বিভাগে বেড রয়েছে ১২টি। অথচ ক্যামোথেরাপি প্রতিদিন দিতে হচ্ছে ১৫/২০ জনকে। এক্ষেত্রে রোগীদের অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। চিকিৎসক ৪ জন থাকার কথা থাকলে পদায়ন রয়েছে এক জনের, মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন একজন। প্রতি ১০ জন রোগীর বিপরীতে ৬ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও সাকুল্যে নার্স রয়েছেন ৩ জন। যে সব রোগীর ক্যামো ও রেডিও থেরাপি দেয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে পুরুষ রোগীর ক্ষেত্রে বেশিরভাগই মুখম-লের বিভিন্ন অংশের ক্যান্সার রোগী। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি রোগী হচ্ছে ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগী। পুরুষ রোগীদের ক্ষেত্রে লাং ক্যান্সার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আর মহিলাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হচ্ছে জরায়ু ক্যান্সার। বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের তথ্য উপাত্ত দেখে কর্মরত চিকিৎসকরা এটাই জানান। বিভাগীয় প্রধান ডাঃ মোবাশ্বের জানান, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী বাড়ার অন্যতম কারণ অসচেতনতা ভেজাল খাদ্য গ্রহণ ও সময় মতো চিকৎসকের কাছে না যাওয়া ছাড়াও পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া অন্যতম কারণ। শজিমেকের ক্যান্সার বিভাগ চালু থাকলেও লোকবল ও রেডিও থেরাপির মেশিনের অচলাবস্থার কারণে রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা পেতে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, লোকবল বাড়ানোসহ নতুন রেডিও থেরাপি মেশিন দ্রুত তারা পেতে পারেন। ইতোমধ্যে কয়েকদফা বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। চিকিৎসকসহ লোকবল বৃদ্ধি ও নতুন রেডিওথেরাপি মেশিন ও সিম্যুলেটর সংযুক্তি হলে এখানে ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা সেবা ও সুবিধা আরও বাড়বে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
×