ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা আসা থামছে না, টেকনাফ-উখিয়ায় অসন্তোষ বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৫ অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা আসা থামছে না, টেকনাফ-উখিয়ায় অসন্তোষ বাড়ছে

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুতে চাপ বাড়ছে মিয়ানমার সরকারের ওপর। সর্বশেষ দোদুল্যমান অবস্থা কাটিয়ে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার হওয়ার পর দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবরোধ আরোপের চিন্তাভাবনা করছে। শুধু তাই নয়, এ সহিংসতার পেছনে যে বা যারাই জড়িত থাকুক না কেন,তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে বলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে আমেরিকার পররাষ্ট্র দফতর। জেনেভায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সভায়ও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পাশাপাশি এ সঙ্কটে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান জানানো হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় চীনের অবস্থানও পাল্টাবে, এমনই আশা করছে বাংলাদেশ সরকার। এদিকে, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক, দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চেষ্টা চলমান থাকার মধ্যেও অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এখনও প্রতিদিনই ঢুকছে রোহিঙ্গা। এ নিয়ে অসন্তোষ পরিলক্ষিত হচ্ছে স্থানীয়দের মধ্যে। স্থানীয় বাসিন্দারা চান রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়া থেকে সরিয়ে নোয়াখালীর ভাসানচরে পুনর্বাসন করা হোক। কিন্তু এক্ষেত্রে বিরোধিতা হাতিয়া ও সন্দ্বীপের অধিবাসীদের। তাছাড়া সেখানে পাঁচ লাখ মানুষের বসতি সৃষ্টি হলে বঙ্গোপসাগরে মৎস্য প্রজনন এবং ব্লু ইকোনমির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে গত ২৫ আগস্ট শুরু হয় বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গা স্রোত। আগের কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে কক্সবাজার জেলায় নতুন করে যুক্ত হয় আরও প্রায় ছয় লাখ। একসঙ্গে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশান্তর স্মরণকালে আর ঘটেনি। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপের মুখে মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি কয়েক দফায় আশাব্যঞ্জক কিছু কথা বললেও শেষ পর্যন্ত সবকিছুই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যায় সে দেশের সেনাপ্রধান মিন অং লাইংয়ের বিপরীতমুখী বক্তব্যে। চলতে থাকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ। প্রকৃতপক্ষে আন্তর্জাতিক চাপকে খুব একটা আমলে নিচ্ছিল না মিয়ানমার সরকার। কেননা, আলোচনা এবং নির্যাতন দুটোই চলে আসছিল একসঙ্গে। কিন্তু সে চাপ ক্রমশ ফলপ্রসূ হতে চলেছে বলে ধারণা করছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গণমাধ্যম। বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশে আসা এ বাস্তুচ্যুতদের ফিরিয়ে নিতেই হবে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব সবার আগে। এটাই ভারত সরকারের অবস্থান। তিনি নিজ দেশের অবস্থান পরিষ্কার করে দেয়ার পর এসেছে মার্কিন হুঁশিয়ারি। আরও কঠোর ভাষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মানবিক সহায়তা দিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অনুমোদন দিতে হবে এবং যারা পালিয়ে গেছে তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বক্তব্য শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞার হুমকিতেই সীমাবদ্ধ নয়, রাখাইনে সহিংসতার পেছনে দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করার হুঁশিয়ারিও এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র আগেও এ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেছে। তবে এবারের বিবৃতি সবচেয়ে কঠোর। অসন্তোষ বাড়ছে টেকনাফ-উখিয়ায় ॥ নতুন এবং পুরনো মিলে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস এখন কক্সবাজার জেলার টেকনাফ এবং উখিয়ায়। এতে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। স্থানীয়দের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ। অস্বস্তিকর এ অবস্থায় তারা রোহিঙ্গাদের হয় মিয়ানমারে ফেরত, নয়ত ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। সময় যতই গড়াচ্ছে অসন্তোষ ততই বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন জেলা এবং স্থানীয় প্রশাসনও। কেননা, ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের একাধিক দফায় মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ তো আছেই। সর্বশেষ গণনা অনুযায়ী উখিয়া এবং টেকনাফে বাঙালী জনসংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের কিছু বেশি। কিন্তু সেখানে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। এতে জীবনযাত্রা এবং জীবিকা কঠিন হয়ে পড়ছে স্থানীয়দের। এদিকে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে আপত্তি রয়েছে সন্দ্বীপ এবং হাতিয়াবাসীর। তাছাড়া সামুদ্রিক মৎস্য নিয়ে কাজ করে এমন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সংস্থাগুলোর অভিমত, জীবিকাহীন এ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বঙ্গোপসাগরের কোন দ্বীপে পুনর্বাসন করলে মাছ ধরাই হবে তাদের প্রধান পেশা। বর্তমানে বৈধ-অবৈধ হাজার হাজার ফিশিং ট্রলার এবং বোট বঙ্গোপসাগরে মৎস্য শিকারে নিয়োজিত। এর সঙ্গে যদি রোহিঙ্গারা যুক্ত হয় তাহলে বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি হুমকির মুখে পড়বে। তাছাড়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মা ইলিশ রক্ষা এবং ইলিশের প্রজনন। পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ থেমে নেই ॥ প্রত্যাবাসনে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক আলোচনা এবং চাপের মধ্যেও রোহিঙ্গারা দলে দলে আসছে বাংলাদেশে। উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে তাদের আসা অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার সকালে টেকনাফের চারটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অন্তত চার হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। পয়েন্টগুলো হলোÑ শাহপরীরদ্বীপ, লম্বাবিল, হ্নীলা ও খারাংখালী। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন আপাতত নেই। তারপরও কেন স্রোতের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, তা স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের অজানা নেই। নতুন করে আর যেন রোহিঙ্গা আসতে না পারে সেজন্য এখনই বাংলাদেশের সীমান্ত সিল করে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান। কক্সবাজারের সায়মন বীচ রিসোর্টের সম্মেলনকক্ষে এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এ দাবি জানান। তিনি বলেন, অতিসম্প্রতি মিয়ানমারের একজন মন্ত্রী বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও মিয়ানমার সফরে। এছাড়া আন্তর্জাতিক নানা ফোরামের মাধ্যমেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারকে সম্মত করানোর চেষ্টা চলছে। যদি ফিরিয়েই নেয়া হয়, তাহলে এখনও রোহিঙ্গা আসছে কেন? আমরাইবা আসতে দেব কেন? তাছাড়া ফেরত পাঠানোর চেষ্টার পাশাপাশি এতসব পুনর্বাসনের আয়োজন রোহিঙ্গাদের এ দেশে থাকার বিষয়ে আশাবাদী করে তুলছে। আমাদের উচিত সীমান্ত এখনই বন্ধ করে দেয়া। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক জানিয়েছেন, মিয়ানমারে আপাতত রোহিঙ্গা নির্যাতন নেই। তারপরও টেকনাফ উপজেলায় গত এক সপ্তাহে প্রায় ২৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা এসেছে। তিনি জানান, রোহিঙ্গা প্রবেশ আগের তুলানায় কিছুটা কমে এলেও সোমবার ভোরে তিন শতাধিক রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা ঢুকছে শাহপরীরদ্বীপ সীমান্ত দিয়ে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোম ও মঙ্গলবার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ট্রাক ও জীপযোগে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। শাহপরীরদ্বীপ সীমান্ত দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের চিড়া, বিস্কুট, শিশুদের দুধ, ডাল ও কাপড় দেয়া হচ্ছে। সরকারী-বেসরকারী সংগঠনগুলো চিকিৎসাও দিচ্ছে তাদের। টেকনাফ-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, রবিবার রাতে শাহপরীরদ্বীপ, জালিয়াপাড়া ও ঘোলাপাড়া পয়েন্ট দিয়ে ২৯ পুরুষ, ২৯ নারী ও ৫৩ শিশু বাংলাদেশে ঢুকেছে। তাদের সাবরাং হারিয়াখালী বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে, টেকনাফ এবং উখিয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা এখন আর রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে আসা নির্যাতনের অভিযোগ বিশ্বাস করছে না। কেননা, কোন গণমাধ্যমেও ওই ধরনের তথ্য এখন নেই, যেমনটি বিশ দিন আগেও শোনা গিয়েছিল। নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে গিয়ে হুমকি-ধমকির যে খবর রোহিঙ্গারা জানাচ্ছে তা তাদের মিথ্যা দাবি। এখন কাউকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা সেই পুরনো কথাগুলোই বলে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা শিশুর লাশ উদ্ধার ॥ উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পসংলগ্ন মাঝের তেলীপাড়া খাল হতে অজ্ঞাত এক রোহিঙ্গা শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা। সাত-আট মাস বয়সের ওই শিশুর লাশ উদ্ধার শেষে মঙ্গলবার সকালে দাফন করা হয়। মৃত শিশুর শরীরে জখমের চিহ্ন রয়েছে। বি-৮৪ ব্লকের রোহিঙ্গা আয়ুব জানান, মৃতদেহটি খালের পশ্চিমে গ্রামের লাল মিয়ার বাড়িসংলগ্ন খালে আটকে পড়েছিল। প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ॥ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে মোট আট লাখ ৮৯ হাজার ৫শ’ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে সহিংসতার পর নতুন করে আসা রোহিঙ্গা পাঁচ লাখ ৮২ হাজার। আগে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে তিন লাখ সাত হাজার ৫শ’ জন। সব মিলিয়ে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আছে নয় লাখের কাছাকাছি। তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থা এবং সংগঠনের ধারণা, এ সংখ্যা ১১ লাখের কম নয়। তবে এর মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। মিয়ানমার থেকে পশু আমদানি অব্যাহত ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বাড়লেও তার প্রভাব পড়েনি টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ ক্যাটেল করিডরে। গবাদিপশু আমদানি অব্যাহত রয়েছে। অবৈধ পন্থায় শাহপরীরদ্বীপ দিয়ে পশু আমদানি সহিংসতার কারণে কমে গেলেও আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা কিছু গরুও অবৈধ পথে ঢুকছে। টেকনাফ স্থলবন্দর কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গবাদিপশু আমদানির জন্য টেকনাফের হ্নীলা ও শাহপরীরদ্বীপে দুটি ক্যাটেল করিডর রয়েছে। তন্মধ্যে হ্নীলা করিডর দিয়ে কোন গবাদিপশু আমদানি হয়নি। শাহপরীরদ্বীপ করিডর দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে মোট গবাদিপশু আমদানি হয়েছে নয় হাজার ৯৪২টি। এর মধ্যে ছয় হাজার ৯৪৬টি গরু, ৪৩০টি মহিষ এবং দুই হাজার ৫৬৬টি ছাগল। এ খাতে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৪২ লাখ এক হাজার ২শ’ টাকা, যা অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি।
×