ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিকদের ইফতার মাহফিল

বাজেটে সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৫ জুন ২০১৭

বাজেটে সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগের পায়ের নিচে নাকি মাটি নেই! ১৯৪৯ সালে এদেশের মাটি ও মানুষের মধ্যে দিয়ে, জনগণের অধিকার আদায়ের মধ্যে দিয়ে আওয়ামী লীগের জন্ম। আওয়ামী লীগের শিকড় এদেশের মাটির অনেক গভীরে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীর হাতে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে যে দলের জন্ম সেই দলের (বিএনপি) পায়ের নিচে মাটি থাকে না, সেটিই হলো বাস্তবতা। প্রস্তাবিত বাজেটে কোন সমস্যা থাকলে আলোচনার মাধ্যমে তা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট আমরা দিয়েছি। এত বড় বাজেট আর কেউ কখনও দেয়নি। এই বাজেট নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। বাজেট পেশ করা হয়েছে, পার্লামেন্টে আলোচনা হবে, হয়তো কারও কিছু সমস্যা থাকতে পারে নিশ্চয়ই তা আমরা দেখব সমাধান করব। আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হব। সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলবই। জঙ্গী-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযান অব্যাহত থাকবে ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, যারা আন্দোলনের নামে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, যারা মানুষ পুড়িয়ে হত্যার হুকুম দিয়েছে- বাংলার মাটিতেই তাদের বিচার করা হবে। কেউই রেহাই পাবে না। রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার ও দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার এ দৃঢ় অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। বিএফইউজে সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের সভাপতিত্বে ও ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরীর সঞ্চালনায় ইফতার মাহফিলে আরও বক্তব্য রাখেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বিএফইউজের মহাসচিব ওমর ফারুক ও ডিইউজে সভাপতি শাবান মাহমুদ বক্তব্য রাখেন। সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মুফতি মিজানুর রহমান মোনাজাত পরিচালনা করেন। ইফতার মাহফিল শেষে প্রধানমন্ত্রী সেখানে নামাজ আদায়ের পর সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন। ইফতার ও দোয়া মাহফিলে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম, আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোজাফফর হোসেন পল্টু, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, দফতর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, তথ্য সম্পাদক এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সবুর, সানজিদা খানম এমপি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, তথ্য সচিব গোলাম মর্তুজা, ওয়াসার পরিচালক হাসিবুর রহমান মানিক ছাড়াও বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। নবম ওয়েজ বোর্ড ঘোষণা সংক্রান্ত সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তার ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরে বলেন, আমরা ইতোমধ্যে নবম ওয়েজ বোর্ড গঠনের কথা বলেছি। কিন্তু মালিক পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধি না দেয়ায় প্রক্রিয়া থেমে আছে। এখানে সরকারের কোন দোষ নেই। অনেক গণমাধ্যম মালিক রয়েছেন। আপনাদের বলব আপনারা প্রতিনিধি দিন। প্রতিনিধি পেলেই আমরা ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করব। আর ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমকেও এই নবম ওয়েজবোর্ডের আওতায় আনতে হবে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতাই শুধু নয়, মাতৃভাষা বাংলার অধিকার এনে দিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। আওয়ামী লীগ কোন অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর হাতে জন্ম রাজনৈতিক দল নয়। তখন অন্য কোন রাজনৈতিক দল এদেশে ছিল না। বিএনপির জন্মই অবৈধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধান লংঘন করে প্রথমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক দলই হচ্ছে বিএনপি। এদেশের মাটি ও মানুষের মধ্যে থেকে এ দলটির জন্ম হয়নি। নীতিহীন সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নীতিহীন সাংবাদিকতা কিংবা হলুদ সাংবাদিকতা কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ সময় বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- নীতিহীন রাজনীতি দেশ ও জাতিকে কিছু দিতে পারে না। তেমনি নীতিহীন সাংবাদিকতা দেশের কোন কল্যাণ করতে পারে না, বরং অনেকক্ষেত্রে সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সাংবাদিক হত্যাসহ অত্যাচার-নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় সাংবাদিকরা সত্যিই এক বিভীষিকাময় অবস্থা পার করেছে। শত শত সাংবাদিক অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অসংখ্য সাংবাদিক হত্যাকা-ের শিকার হলেও ওই সময় একটি সাংবাদিক হত্যার বিচার করা হয়নি। তিনি বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের যেমন বিচার করেছি ও করছি, তেমনি প্রতিটি সাংবাদিক হত্যাকা-ের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছি। অন্যায় করে কেউ পার পাবে না। আত্মবিশ্বাস নেই বলেই বিএনপি নেত্রী মামলা মোকাবেলা করতে ভয় পান উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। সেই মামলা মোকাবেলা করতে উনি ভয় পান। মামলাকে বিলম্বিত করতে ১৪৬ বার রিটসহ নানা প্রকারে সময় চেয়েছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তার ভয়টা কীসের? বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমার বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা দেয়া হয়েছিল। আমার আত্মবিশ্বাস আছে আমি কোন অন্যায় করিনি। তাই চ্যালেঞ্জ করেই মামলাগুলো মোকবেলা করেছি। আসলে বিএনপি নেত্রীর আত্মবিশ্বাস নেই আর এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন বলেই মামলা মোকাবেলা করতে উনি ভয় পান। যাদের এই আত্মবিশ্বাসের অভাব তারাই মামলা থেকে পলায়ন করে। এতিমের টাকা মেরে খেয়ে পলায়ন করে যাবে কতদূর সেটাও একটা কথা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালীর জীবনে যদি ১৫ আগস্টের ঘটনা না আসতো, জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো তবে স্বাধীনতার দশ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ সারাবিশ্বের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই শুরু হয় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। যার শিকার হতে হয় সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীসহ মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের। অনেক বলেন জিয়াউর রহমান নাকি গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন? উনি প্রতি রাতে কার্ফু দিয়ে দেশ চালিয়েছেন। এটাকে কার্ফু গণতন্ত্র বললে আমার কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খুনী মোশতাক এক সেনাপ্রধানকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেন। সেনাপ্রধান হয়েই রাষ্ট্রপতি সায়েমকে গিয়ে জিয়াউর রহমান বলেন, ‘স্যার আপনি অসুস্থ। তখন সায়েম সাহেব বলেন আমি তো সম্পূর্ণ সুস্থ। তখন জিয়াউর রহমান অস্ত্র দেখিয়ে তাকে পদত্যাগ করিয়ে সংবিধান ও সেনা আইন লংঘন করে জিয়াউর রহমান একধারে নিজে রাষ্ট্রপতি ও সেনা প্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকে দেশে ১৯টা ক্যু হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় নিয়ে আসায় বাংলাদেশের উন্নয়ন থমকে যায়। সঙ্গীনের খোঁচায় সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত এবং নির্বাচনে কারচুপির সূচনাও করেন এই জিয়াউর রহমান। নিজেকে সাংবাদিক পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুৃর কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনিও কিন্তু তার জীবন সাংবাদিকতা দিয়ে শুরু করেছিলেন। সে কারণে আমি সব সময় দাবি করি আমি আপনাদেরই পরিবারের একজন সদস্য। তিনি বলেন, সাংবাদিকতারও নীতি থাকতে হবে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি। সব কিছু নিয়ে সমালোচনা হয় কেউ আপনাদের কিছু বলে না। কই অন্য সময় তো তা পারেন নাই কখনও। আওয়ামী লীগ সময়ে পারেন। টকশো’ তো ইচ্ছামতো কথা বলে যায় সত্য মিথ্যা দিয়ে। আমরা কখনও বাধা দেই না। তিনি বলেন, আমরা তো সুযোগ করে দিয়েছি। বেসরকারী টেলিভিশন না চললে এত টকশো’ চলতো কিভাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আগে তো একটাও বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। জঙ্গী-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করে শেখ হাসিনা বলেন, জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যহত থাকবে। সেখানে আপনাদের সহযোগিতা চাই। জঙ্গীবাদ,সন্ত্রাস, মাদকের বিরুদ্ধেও আমাদের অভিযান অব্যহত রাখব। আর মানুষ পুড়িয়ে যারা হত্যা করেছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের বিচার হবেই। এ মামলা নিয়ে অনেক কথা বলবে যে মামলা হয়েছে, মামলা হয়েছে... কিন্তু মামলা খামোখা হয়নি। জীবন্ত মানুষগুলো পুড়িয়েছে। শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তাই যারা মানুষ পুড়িয়েছে হকুমদাতাসহ তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই। ভিক্ষুকের জাতি নয়, আমরা আত্মনির্ভরশীল হতে চাই- উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির রাজনীতিই হচ্ছে জাতিকে ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে দেখিয়ে বিদেশ থেকে ভিক্ষা এনে লুটে খাওয়া। যারা জাতিকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করে রাখতে চায়, তারা দেশের কল্যাণ করবে কীভাবে? কিন্তু আমাদের সরকারের নীতিই হচ্ছে- আমরা ভিক্ষা নিয়ে চলতে চাই না। আত্মনির্ভরশীল হতে চাই। সে কারণেই আমরা দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি। বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। সাংবাদিকদের কল্যাণে তার সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সাংবাদিকদের জন্য কল্যাণ ফান্ড গঠন করে দিয়েছি। ৭ কোটি টাকার সিড মানি দিয়েছি। তথ্য অধিকার আইন করে দিয়েছি। সংবাদপত্রকে সেবা শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছি। আগে মামলা হলেই সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হতো। কিন্তু মামলা হলেই সংবাদপত্রের মালিক-সাংবাদিকদের গ্রেফতার করতে না পারে সেজন্য আইন সংশোধন করেছি। এর ফলে গ্রেফতার নয়, সমন দেয়া হবে। আর আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্য জমির ব্যবস্থার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। আর উত্তরায় রাজউকের ফ্ল্যাটের কিছু রাখতে বলেছি, সেখান থেকে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তি দিয়ে সাংবাদিকরা ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারবেন।
×