ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গুলশান হত্যাযজ্ঞের নেতিবাচক প্রভাব

২৩ হাজার বিদেশী পর্যটকের বুকিং বাতিল ১২ দিনে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৪ জুলাই ২০১৬

২৩ হাজার বিদেশী পর্যটকের বুকিং বাতিল ১২ দিনে

আজাদ সুলায়মান ॥ গুলশান হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিদেশী পর্যটকরা বাংলাদেশে তাঁদের ভ্রমণ বাতিল করছেন। গত ১২ দিনে প্রায় ২৩ হাজার বিদেশী পর্যটক তাদের বুকিং বাতিল করেছেন। ভ্রমণ বাতিলের তালিকায় শুধু চলতি বছরই নয়-২০১৭ সাল পর্যন্ত তারা বুকিং বাতিল করে দিচ্ছেন। ভ্রমণ বাতিলের তালিকায় জাপান ও ইউরোপের পর্যটকরাই বেশি। ইতিমধ্যে যাঁরা ভ্রমণে এসেছেন, তাঁরাও এ দেশে কম সময় অবস্থান করছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে যত জনের ভ্রমণে আসার কথা ছিল, ততজন আসছেন না। ছোট হয়ে যাচ্ছে পর্যটক বহর। অথচ চলতি বছরকে সরকার পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করে ১০ লাখ বিদেশী পর্যটক আগমনের আশা করছে। পর্যটন বোদ্বারা বর্তমান অবস্থাকে বড় ধরনের বিপর্যয় হিসেবে চিহ্নিত করছেন। ভুক্তভোগীরা চরম হতাশা প্রকাশ করে জানিয়েছেন- তাদের প্রকৃত চিত্র। এ খাতের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠতে চলতি মাসের শেষে বিমানমন্ত্রী দেশের সব ট্যুর অপারেটরদের নিয়ে জরুরী কনফারেন্স ডেকেছেন। সেখানেই পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে বলে জানা গেছে। এ সম্পর্কে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারী হোটেল মোটেল কক্সবাজারের সী পার্ল বীচের কর্ণধার আমিনুল হক শামীম জনকণ্ঠকে বলেন, গুলশান হত্যাকা-ের পর তার বিদেশী অতিথি কিছুটা কমে গেছে। সামনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা বড় টিম আসার বুকিং রয়েছে। তবে ইতোমধ্যে বেশ কজন বিদেশী অতিথি এ হোটেলের বুকিং বাতিল করেছেন। যদিও গুলশান ও শোলাকিয়া হত্যাকা-ের পর সরকার কক্সবাজারের প্রতিটি হোটেল মোটেল ও সী বিচে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। তবুও অজানা আতংকে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচেছ এসব হোটেল মোটেল। এখন মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে, কক্সবাজারের নিরাপত্তায় এতটুকু ঘাটতি নেই। বিদেশী অতিথিরা নিরাপদেই এখানে আসতে পারেন। এসব বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমণ নিয়ে কাজ ট্যুর অপারেটরস এ্যাসোসিয়েশনের। সংগঠনটির সদস্যরা বলছেন, গুলশান হামলা ও ঈদের দিন শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ২৩ হাজার বিদেশী পর্যটক এ দেশে তাঁদের ভ্রমণের বুকিং বাতিল করেছেন। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। এ ছাড়াও পর্যটন বর্ষ উপলক্ষে বাড়তি বিনিয়োগ করায় ট্যুর অপারেটরদের ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পর্যটন খাতের প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু হোটেল-রিসোর্টের ক্ষতিই ৫০ কোটি টাকা। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে মানববন্ধনও করেছে ট্যুর অপারেটরস এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)। জাপানী পর্যটকদের এ দেশে ভ্রমণ নিয়ে কাজ করে বেঙ্গল ট্যুরস। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি আট থেকে ১০ হাজার পর্যটকের ভ্রমণ পরিচালনা করে থাকে। বেসরকারী ট্যুর অপারেটর বেঙ্গল ট্যুরের প্রধান নির্বাহী মাসুদ হোসেন বুধবার জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, চুয়াল্লিশ বছরের ইতিহাসে পর্যটন খাতে এতবড় দুর্যোগ কখনও আসেনি। বিগত ২০১১- ২০১৩ সাল পর্যন্ত পর পর তিনটি বছর পর্যটন খাত ছিল বাম্পার। তারপর ২০১৪ সাল থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা আঘাত হানে এ খাতে। কমতে থাকে পর্যটক। সেটা এসে ঠেকে গুলশান ও শোলাকিয়া পর্যন্ত। এরপর থেকে বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা কমতে কমতে এখন তা পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। বিশেষ করে গত ১২ দিনে তাদের সাড়ে তিন হাজার বিদেশী পর্যটক বুকিং বাতিল করেছেন। এর মধ্যে জাপানী ও ইউরোপিয়ান পর্যটকের সংখ্যাই বেশি। আগামী সপ্তাহে জাপানের ৩০ জনের একটি পর্যটক গ্রুপ বাংলাদেশে ভ্রমণে আসার কথা ছিল। বুধবার তারা বুকিং বাতিল করেছেন। আগামী ২০১৭ সাল পর্যন্ত তাদের বুকিং প্রতিদিনই বাতিল হয়ে যাচ্ছে। তারা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। বেসরকারী ট্যুর অপারেটর জার্নি প্লাসের অন্তত ২০টি পর্যটক দল এ দেশে তাদের ভ্রমণ বাতিল করেছে। আর পাঁচটি পর্যটক দলের আয়তন কমে গেছে। উল্লেখ্য, পর্যটনকে চাঙ্গা করতে ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। এজন্য বিদেশী পর্যটকের আগমন বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১৮ সালের মধ্যে ‘ভিজিট বাংলাদেশ কর্মসূচী’র আওতায় বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা ১০ লাখ এবং এ খাত থেকে আয়ের পরিমাণ প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সরকার। ২০২০ সাল নাগাদ সারাবিশে^ পর্যটকের সংখ্যা ১৬০ কোটি হবে বলে ধারণা করা হয়। পর্যটকদের প্রায় ৭৩ শতাংশ এশিয়ার দেশগুলোতে ভ্রমণ করবে বলেও অনুমান করা হয়। বাংলাদেশকে অন্যতম প্রধান গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল সে হিসেব কষেই। কিন্তু এখন জঙ্গী হামলায় বিদেশীদের হত্যাযজ্ঞের কারণে অনিশ্চয়তায় পড়ছে। এ বিষয়ে ট্যুর অপারেটরস এ্যাসোসিয়েশন টোয়াবের পরিচালক তারিক রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশীদের ওপর হামলার কারণে তাদের অনেক বিদেশী পর্যটক গ্রুপ ভ্রমণ বাতিল করেছে। এর আগে দিনাজপুরে ইতালিয়ান পাদ্রির ওপর হামলা, শিয়া মসজিদে হামলা এবং জেএমবি সদস্যদের গ্রেফতার প্রভৃতি বেশি প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, বিদেশীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে আস্থার সঙ্কট কাটছে না। এমনিতেই গত তিন বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারিয়েছে পর্যটনশিল্প। তবে পর্যটনবর্ষকে ঘিরে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখলেও তা গুড়েবালিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যে সব বিদেশী পর্যটকের আসার কথা রয়েছে, তারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ট্যুর অপারেটররা আশ^াস দিলেও বিদেশী পর্যটকরা ভরসা পাচ্ছেন না। তারা বুকিং বাতিল করে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে বেসরকারী ট্যুর অপারেটর বেঙ্গল ট্যুরের প্রধান নির্বাহী মাসুদ হোসেন বলেন, গুলশান ঘটনার পর গত কয়েক দিনে সব ট্যুর অপারেটরের প্রায় ২৩ হাজার বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। এটা ট্যুর অপারেটরদের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির ব্যাপার। এ ঘটনা থেকে উত্তরণে করণীয় ঠিক করতে পর্যটন খাতের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ের বসা উচিত। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের উচিত পররাষ্ট্র মšúণালয়ের মাধ্যমে বিদেশী মিশনগুলোকে আপডেট নিউজ দেওয়া। যাতে পর্যটকদের ভীতি কাটে। ইতালিয়ানদের ট্যুর অপারেটর হিসেবে কাজ করে রিভারাইন ট্যুর। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম বুলু বলেন, ইতালিয়ানরা বুকিং বাতিল করছে। আবার অন্য দেশের অনেক পর্যটক বুকিং পর্যবেক্ষণ তালিকায় পরিবর্তন করেছে। গত কয়েক দিনেই সব ট্যুর অপারেটরের ২০ হাজারের বেশি বুকিং বাতিল হয়ে গেছে। এ কারণে পর্যটন শিল্প এ বছর যে ক্ষতিরমুখে পড়তে যাচ্ছেÑ তা কল্পনাতীত। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান অপরুপ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, গুলশান, শোলাকিয়া হত্যাযজ্ঞের দরুন পর্যটন খাতে যে বিপর্যয় নেমেছেÑ তা রিকভার করতে এখন সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে মিডিয়া। কারণ বাংলাদেশে এ ধরনের হত্যাকা- এখনও বিচিছন্ন ঘটনা। অথচ ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, সুইজারল্যান্ড, এমনকি মদীনায় পর্যন্ত এ ধরনের হামলার পর তারা ঠিকই বছরের মাথায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওসব দেশের মিডিয়া বিশ্বব্যাপী বার্তা পাঠিয়েছে যে, হামলার পর ব্যাপক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিদেশী পর্যটকের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করতে পারার কারণেই বার বার হামলার পরও ও সব দেশের পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমাদেরও তাই করতে হবে। বিশ্বে এমন বার্তা পাঠাতে হবে যে, পর্যটন স্পটগুলোতে ব্যাপক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার স্পটগুলোতে সর্বক্ষণিক টুরিস্ট পুলিশ, আর্চ ওয়ে চেকসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে। নিñিদ্র নিরাপত্তার এ বার্তা যত বেশি প্রচার করা হবে ততো দ্রুতই বাড়তে থাকবে পর্যটক। জানতে চাইলে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, এ মাসের শেষে সরকারী বেসরকারী সব ট্যুর অপারেটরদের নিয়ে বিশেষ কনফারেন্স ডাকা হচ্ছে। সেখানেই সবার মতামত নিয়ে ঠিক করা হবে কর্ম কৌশল। এ জন্য ঢাকায় বিদেশী সব দূতাবাসকে ডেকে তাদের পর্যটন স্পটগুলোর নিরাপত্তার সম্পর্কে নিশ্চিত করা হবে। দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় ইতিবাচক প্রচার চালানো হবে। যাতে বিদেশীদের আস্থা ফেরানো যায়।
×