
“সচিবালয়ে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবহার: একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকমুক্ত পরিবেশের ভবিষ্যৎ” শীর্ষক একটি সেমিনার আজ বাংলাদেশ সচিবালয়ের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাল্টিপারপাস হলে অনুষ্ঠিত হয়। সচিবালয় ও আশেপাশের এলাকায় একক-ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (SUP) নির্মূলের জরুরি প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করতে এই সেমিনারে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো অংশগ্রহণ করে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারী অফিসসমূহে আরও বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের পথ উন্মোচিত হবে বলে আশা ব্যক্ত করা হয়।
এই সেমিনারটি “বাংলাদেশে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবহারে সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি ও সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধ” প্রকল্পের আওতায় আয়োজন করা হয়, যা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের (MoEFCC) আওতাধীন পরিবেশ অধিদপ্তরের (DoE) বাস্তবায়নে পরিচালিত হচ্ছে। এতে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে জাতিসংঘ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (UNIDO) এবং আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ঢাকাস্থ রয়্যাল নরওয়েজিয়ান দূতাবাস। প্রকল্পটি একটি সার্কুলার অর্থনীতিভিত্তিক পন্থা গ্রহণ করেছে, যার লক্ষ্য হলো প্লাস্টিকের উৎপাদন, ব্যবহার, পুনচক্রীকরণ ও পুনর্ব্যবহারের প্রতিটি ধাপে টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা, বর্জ্য হ্রাস করা, সম্পদের দক্ষ ব্যবহার বাড়ানো এবং পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উৎসাহ প্রদান করা।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন UNIDO- বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. জাকী উজ জামান। আরও বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাজরুল ইসলাম এবং অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান, এনডিসি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শেখ আব্দুর রশিদ প্লাস্টিক দূষণকে “নীরব ঘাতক” হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং একে আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুতর পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি মানব ইতিহাসের আলোকে প্লাস্টিককে "আধুনিক যুগের দৈত্য" হিসেবে আখ্যা দেন, যা আমাদের ভোগবাদী অভ্যাস থেকেই সৃষ্ট। “আমরা বিলাসবহুল পণ্যে হাজার টাকা ব্যয় করি, অথচ ৩০ টাকার একটি পাটের ব্যাগ কিনতেও দ্বিধা করি,” মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আচরণগত পরিবর্তন, নাগরিক সচেতনতা এবং বিশেষ করে চিকিৎসা বর্জ্যের কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ফাহমিদা খানম “আশা ও প্রত্যাশা” শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে তিনি প্লাস্টিক দূষণের কারণে পরিবেশ, প্রতিবেশ, জনস্বাস্থ্য এবং জাতীয় অর্থনীতির উপর সৃষ্ট গুরুতর প্রভাব তুলে ধরেন। তিনি খাদ্য শৃঙ্খলে মাইক্রো ও ন্যানো প্লাস্টিকের অনুপ্রবেশের বিষয়ে সতর্ক করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তিনি “ব্যবহার হ্রাস, পুনর্ব্যবহার ও পুনঃ প্রক্রিয়াজাতকরণব” এই নীতির বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন এবং পরিবেশ আইনের ও বিধানসমূহের কঠোর বাস্তবায়ন ও ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানোর আহ্বান জানান।
ড. জাকী উজ জামান, জাতিসংঘ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (UNIDO)-এর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, তাঁর বক্তব্যে বলেন, প্লাস্টিক দূষণ শুধু একটি জাতীয় সংকটই নয়, এটি একটি বৈশ্বিক হুমকি যা মানুষ এবং প্রাণীকুল উভয়ের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। তিনি বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরের জন্য উদ্ভাবনী ও সার্কুলার কৌশল গ্রহণের ওপর জোর দেন এবং বাংলাদেশ সরকারকে টেকসই শিল্পায়ন ও পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি প্রসারে UNIDO-র অব্যাহত সহায়তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সচিবালয় এলাকায় অফিস সম্প্রসারণের পরিকল্পনার কথা জানান, যার মধ্যে GPO কমপ্লেক্সকে ভূগর্ভস্থ করিডোরের মাধ্যমে সংযুক্ত করার প্রস্তাবও রয়েছে। তিনি সচিবালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের প্লাস্টিক বর্জ্যমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখার উদ্যোগের প্রশংসা করেন।
অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, এক সময় প্রাকৃতিক তন্তুর পরিবর্তে প্লাস্টিককে তার সহজলভ্যতা ও সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে সমাদৃত করা হয়েছিল। তবে এখন প্লাস্টিক দূষণ একটি জাতীয় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতির অভাব ছিল।
সমাপনী বক্তব্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান, এনডিসি, বলেন, সচিবালয়ের মতো জাতীয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে এই সেমিনারের আয়োজন একটি প্রতীকী পদক্ষেপ। সচিবালয়ে নেওয়া পদক্ষেপগুলো সরকারী প্রশাসনের সকল স্তরে অনুরূপ উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে পারে।
সেমিনারে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়, যেখানে প্লাস্টিক দূষণের ব্যাপকতা ও প্রভাব দেখানো হয়। পরে পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ এর সঞ্চালনায় মুক্ত আলোচনা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অংশগ্রহণকারীরা তাঁদের মতামত ও সুপারিশ উপস্থাপন করেন।
এই সেমিনার উদ্যোগ ভোক্তা সচেতনতামূলক উপাদানের অংশ, যার আওতায় ইতোমধ্যে সারা দেশে ৩০টিরও বেশি সেমিনার ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে স্কুল, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, উপকূলীয় গ্রাম, পর্যটন এলাকা ও স্থানীয় বাজার। সচিবালয়ে এই উদ্যোগ সরকারের শীর্ষ প্রশাসনিক পর্যায় থেকে নেতৃত্বের এক উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রাজু