ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

ঢাকার বাতাসা, নারকেলের নাড়ু—শিশুদের খাবারের তালিকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লোকজ মিষ্টির ঐতিহ্য

এলেন বিশ্বাস, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ২৮ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০০:৪৭, ২৮ জুলাই ২০২৫

ঢাকার বাতাসা, নারকেলের নাড়ু—শিশুদের খাবারের তালিকা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে লোকজ মিষ্টির ঐতিহ্য

একটা সময় ছিল, যখন বিকেলের আড্ডা কিংবা উৎসবের দিন মানেই শিশুরা অপেক্ষায় থাকত বিশেষ কিছু খাবারের জন্য। না, সেটা ছিল না বার্গার, পিজ্জা বা চিপস। বরং তারা খুঁজত বাতাসা, মুড়কি, নারকেলের নাড়ু, তিলের লাড্ডু বা খেজুর গুড়ের মোয়া। বিশেষ করে পুরান ঢাকার অলিগলিতে বেড়ে ওঠা একটি প্রজন্মের স্মৃতিতে গাঁথা রয়েছে এমন শত রকম লোকজ মিষ্টির স্বাদ, যার উপস্থিতি আজকের শিশুদের কাছে প্রায় অপরিচিত।

পুরান ঢাকার লালবাগ, সূত্রাপুর, ইসলামবাগ কিংবা বংশালের পথে হাঁটলেই এক সময় চোখে পড়ত ছোট ছোট দোকানে সাজানো বাতাসা, নাড়ু, তিলের সন্দেশ, ঝুরাভাজা মুড়কি। রাস্তার পাশে হকাররা বাচ্চাদের ডেকে বলতেন—“এই যে বাতাসা নে মা, নাড়ু খা বাবা!” এখন এসব ডাক আর শোনা যায় না। আধুনিকতা, শহুরে ব্যস্ততা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে এসব ঐতিহ্যবাহী খাবার আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে।

বংশালের ৭০ বছর বয়সী আব্দুল হাকিম নামে একজন স্থানীয় বলেন, “আমাদের ছোটবেলায় দোকানদারদের মুখে মুখে রকমারি মিষ্টি—কেউ বলতো ‘শীতের নাড়ু এসেছে’, কেউ বলতো ‘তাজা বাতাসা নেন’। ছোটরা গোল হয়ে বসে খেতো। এখন ওসব দোকানই আর নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তনের জন্য দায়ী মূলত তিনটি বিষয়—আধুনিক প্যাকেটজাত খাবারের আগ্রাসন, লোকজ খাবারের উৎপাদন সংকট ও শহুরে সংস্কৃতির ছকভাঙা রূপান্তর।

 শুধু খাদ্য নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক সংকট। আমরা শিশুদের বিদেশি খাবারে অভ্যস্ত করে তুলছি, ফলে তারা নিজের দেশের ঐতিহ্য ও স্বাদের সঙ্গে সম্পর্ক হারাচ্ছে।

প্রযুক্তিনির্ভর সময়ের শিশুরা জন্ম থেকেই মোবাইল, ট্যাব আর টিভিতে বড় হচ্ছে। তারা আর বিকেলে বাইরে খেলতে যায় না, যায় না পাড়ার দোকানে নতুন কিছু খুঁজতে। ফলে বাতাসা-নাড়ুর মতো আবিষ্কারগুলো তাদের জ্ঞানের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

লোকজ মিষ্টান্নগুলোর পেছনে ছিল স্বাস্থ্যগুণও। নারকেলের নাড়ু বা তিলের লাড্ডুতে কোনো কৃত্রিম রং বা রাসায়নিক থাকত না। বরং এতে থাকত প্রাকৃতিক উপাদান—নারকেল, খেজুর গুড়, তিল, চালের গুঁড়া ইত্যাদি, যেগুলো শিশুদের জন্য পুষ্টিকর। অথচ আজকালকার প্যাকেটজাত চকলেট, চিপস কিংবা ক্যান্ডিতে থাকে অতিরিক্ত চিনি, ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ এবং বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদান, যা দীর্ঘমেয়াদে শিশুর স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে।

বাতাসা একসময় শুধু শিশুদের জন্যই নয়, বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচারেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঈদে বাতাসা দিয়ে মেহমান আপ্যায়ন, পূজায় প্রসাদ হিসেবে বাতাসা দেওয়া, এমনকি লোকাচার অনুযায়ী কনে বিয়েতে যাওয়ার সময় বাতাসা দেওয়া—এসব ছিল এক সময়ের দৃশ্যপট। কিন্তু এখন বাতাসা পাওয়া যায় হাতে গোনা কিছু দোকানে, আর তা-ও কম মূল্যে বিক্রি করতে গিয়ে মান হারিয়েছে।

রাজধানীর এক দোকানদার বলেন আগে বাতাসা বানানোর জন্য আলাদা লোক ছিল। এখন আর কেউ শিখতে চায় না। তরুণরা বলে, এতে লাভ নেই। সবাই এখন বেকারি বা ফাস্টফুডে চাকরি করতে চায়।

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক এসব খাবারকে ফিরিয়ে আনতে চাই উদ্যোগ ও সচেতনতা। পাড়ায় পাড়ায় আয়োজন করা যেতে পারে লোকজ খাবার উৎসব। স্কুলের মিড-ডে মিল বা ক্যান্টিনে সপ্তাহে অন্তত একদিন রাখা যেতে পারে বাতাসা, নাড়ু বা মুড়কির মতো মিষ্টি। শিশুদের বইয়ে, গল্পে, এমনকি কার্টুনেও তুলে ধরা যেতে পারে এসব ঐতিহ্য।

শিশুরা যদি জানতে না পারে বাতাসা কী, নাড়ু কেন বানানো হতো—তবে তারা নিজের মাটি চিনবে কীভাবে? তাই শিশুদের ঐতিহ্যের স্বাদ দিতে হলে পরিবার ও রাষ্ট্র দু’জনকেই এগিয়ে আসতে হবে।

পুরান ঢাকার বাতাসা কিংবা নারকেলের নাড়ু শুধু খাবার নয়—এগুলো আমাদের শিকড়, সংস্কৃতি, এবং ইতিহাসের অংশ। এই খাবারগুলো ছিল বাঙালির প্রাণের প্রকাশ। আজকের প্রজন্মকে যদি আমরা শুধু আধুনিকতার নামে বিদেশি খাবারে অভ্যস্ত করে তুলি, তবে হারিয়ে যাবে সেই স্বাদ, সেই গল্প, সেই শেকড়—যা আমাদের আসল পরিচয়।

তাই এখনও সময় আছে—আমরা চাইলে আবারও ফিরিয়ে আনতে পারি বাতাসার সেই মিষ্টি দিন। এক ফোঁটা গুড়, এক চিমটি স্মৃতি, আর কিছুটা ভালোবাসা মিশিয়ে।

নুসরাত

×