ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

রুব’ আল খালি: বিশ্বের সবচেয়ে বড় বালুর মরুভূমির রহস্য

মোহাম্মদ সানাউল হক, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, রিয়াদ

প্রকাশিত: ২২:৩০, ২৬ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ২২:৩১, ২৬ জুলাই ২০২৫

রুব’ আল খালি: বিশ্বের সবচেয়ে বড় বালুর মরুভূমির রহস্য

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বালুর মরুভূমির নাম রুব' আল খালি, ইংরেজিতে পরিচিত “The Empty Quarter” বা “খালি কোয়ার্টার” নামে। আরব উপদ্বীপের অন্তরে বিস্তৃত এই বিশাল মরুভূমি আয়তনের দিক থেকে প্রায় ৬,৫০,০০০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত, যা একসঙ্গে ফ্রান্স বা ইউরোপের কয়েকটি দেশের সমান। সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইয়েমেনের ভেতর ছড়িয়ে থাকা এই অসীম বালুর সমুদ্র প্রকৃতির সবচেয়ে কঠিন ও অনন্য ভূখণ্ডগুলোর একটি।

এই মরুভূমির বিশালতা শুধু ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতার কারণে নয়, এর কঠোর পরিবেশের জন্যও কিংবদন্তি হয়ে আছে। অগণিত উঁচু বালুর টিলা, তপ্ত সূর্য, পানিশূন্যতা ও চরম আবহাওয়া একে মানব বসতির জন্য প্রায় অযোগ্য করে তুলেছে। বছরের প্রায় পুরোটাই বৃষ্টিশূন্য, আর গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে, যা জীবনের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এই কারণেই রুব' আল খালি যুগ যুগ ধরে রহস্যের প্রতীক হয়ে আছে, যেখানে প্রকৃতি তার সবচেয়ে কঠিন রূপে বিরাজ করছে।

“রুব' আল খালি” নামটির অর্থই বোঝায় “শূন্য এক-চতুর্থাংশ”, অর্থাৎ আরব উপদ্বীপের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এক শূন্য মরুভূমি। এখানে নেই কোনো স্থায়ী বসতি, নেই কৃষিকাজ, নেই স্থায়ী জলাশয়ের অস্তিত্ব। ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা এর নির্জনতা দেখে ইংরেজিতে একে “The Empty Quarter” নামে অভিহিত করেন, যা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায়। এই নাম শুধু শূন্যতাকেই প্রকাশ করে না, মানব সভ্যতার অনুপস্থিতির প্রতীক হিসেবেও কাজ করে।

রুব' আল খালির সীমারেখা নির্ধারিত হয়েছে প্রাকৃতিক ভূ-প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। উত্তরে বিস্তৃত নাজদ মালভূমি, পূর্বে পারস্য উপসাগরের উপকূলীয় সমভূমি, দক্ষিণে দুর্গম হাদরামাউত পর্বতমালা এবং পশ্চিমে ইয়েমেনের উচ্চভূমি এর চারপাশ ঘিরে রেখেছে। এই প্রাকৃতিক সীমারেখাগুলো শুধু ভৌগোলিক বিভাজন নয়, জলবায়ু, প্রাণীকুল এবং মানব চলাচলের ধরনকেও প্রভাবিত করেছে। মরুভূমির ভেতরে গড় বালুর টিলার উচ্চতা ১৫০–২০০ মিটার, কিছু টিলা এমনকি ২৫০ মিটার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বিশেষ করে উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকালে টিলাগুলো যেন তরঙ্গায়িত বালুর সমুদ্র তৈরি করে, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও খুব কমই দেখা যায়।

রুব' আল খালির প্রাকৃতিক পরিবেশ অত্যন্ত বৈরী। গ্রীষ্মকালে দিনের বেলায় সূর্যের প্রখরতা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যায়, আর শীতে রাতের বেলা তাপমাত্রা নেমে আসে শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি। বছরের প্রায় পুরোটাই শুষ্ক থাকে, ফলে এখানে কোনো প্রাকৃতিক পানির উৎস গড়ে ওঠেনি। এই কঠোর পরিবেশই মানব সভ্যতাকে এখানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন থেকে বিরত রেখেছে। তবে প্রাকৃতিক শূন্যতার মধ্যেও রুব' আল খালি অসাধারণ নান্দনিক সৌন্দর্যের অধিকারী। টিলাগুলোর রঙ কখনো লালচে, কখনো সোনালি, কখনো বাদামি আভায় সেজে ওঠে। বিশেষ করে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এই টিলাগুলো এক মায়াবী দৃশ্য তৈরি করে, যা দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।

ইতিহাসে বলা হয়, হাজার বছর আগে বেদুইন যাযাবররা এই মরুভূমি অতিক্রম করত। তারা উটের কাফেলাসহ বাণিজ্যপথ ধরে চলাচল করত, তবে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলতে পারত না। পানি ও খাদ্যের অভাব, চলাচলের অসুবিধা এবং চরম আবহাওয়া তাদেরকে চলমান জীবনধারায় অভ্যস্ত করে তোলে। বেদুইনদের অভিযোজন ক্ষমতা অসাধারণ হলেও, রুব' আল খালি ছিল তাদের জন্যও ভয়ংকর চ্যালেঞ্জের এলাকা।

রুব' আল খালি শুধু প্রাকৃতিকভাবে নয়, কিংবদন্তিতেও সমৃদ্ধ। সবচেয়ে আলোচিত কিংবদন্তি হলো হারিয়ে যাওয়া শহর “উবার” বা “Atlantis of the Sands”। ধারণা করা হয়, এই শহর একসময় আরব উপদ্বীপের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, যা পরবর্তীতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। আধুনিক স্যাটেলাইট গবেষণায় মরুভূমির নিচে প্রাচীন নদীর চিহ্ন ও কিছু ধ্বংসাবশেষের সন্ধান মিলেছে, যা এই কিংবদন্তিকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। ইতিহাসবিদদের মতে, উবার শহর আরবের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তাই এর ধ্বংসাবশেষের সন্ধান মরুভূমির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে নতুন আলোকে তুলে ধরেছে।

রুব' আল খালি সম্পর্কে প্রথম বৈজ্ঞানিক তথ্য আসে ১৯৩০-এর দশকে, যখন অভিযাত্রী বার্থেল থমাস ও উইলফ্রেড থেসিজার এই অঞ্চল ভ্রমণ করেন। তারা বিশ্ববাসীর সামনে মরুভূমির কঠোর বাস্তবতা ও অনন্য সৌন্দর্যের চিত্র তুলে ধরেন। তাদের ভ্রমণকাহিনি থেকে বোঝা যায়, এখানে শত শত কিলোমিটার হাঁটলেও মানুষের অস্তিত্বের দেখা পাওয়া যায় না। এই অভিযাত্রীদের কারণে রুব' আল খালি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।

যদিও এই মরুভূমি শূন্যতার জন্য বিখ্যাত, কিন্তু জীববৈচিত্র্য একেবারেই নেই তা নয়। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির টিকটিকি, সাপ, বিচ্ছু, পোকামাকড় এবং কিছু প্রজাতির পাখি দেখা যায়। সাম্প্রতিক সংরক্ষণ কার্যক্রমের ফলে আরবীয় ওরাইক্স (হরিণজাতীয় প্রাণী) এবং বন্য উট ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কঠিন পরিবেশেও এই প্রাণীকুলের অভিযোজন ক্ষমতা প্রকৃতির বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।

স্যাটেলাইট চিত্র এবং ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, রুব' আল খালির নিচে রয়েছে বিশাল তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার। এই ভাণ্ডার সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করেছে। একসময় যে মরুভূমি মানব জীবনের জন্য অযোগ্য ছিল, সেটি আজ বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। বলা যায়, এই মরুভূমি সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির এক অদৃশ্য ভিত্তি তৈরি করেছে।

আজকের দিনে রুব' আল খালি শুধু ভূগোল বা ইতিহাসের কারণে নয়, পর্যটন ক্ষেত্রেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মরুভূমি সাফারি, ক্যাম্পিং, হট এয়ার বেলুনে ভ্রমণ এবং বেদুইন জীবনধারা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। বিশেষ করে আল আহসা ও নাজরান অঞ্চলে পর্যটন কার্যক্রমের বিস্তার এই মরুভূমির গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

তবে এখানে ভ্রমণের আগে নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো স্থায়ী পানির উৎস নেই, আবহাওয়া অনিশ্চিত এবং হঠাৎ ধুলিঝড় দেখা দিতে পারে, যা ভ্রমণকারীদের দিকনির্দেশনা হারিয়ে ফেলার ঝুঁকি তৈরি করে। পর্যাপ্ত পানি, খাদ্য, সুরক্ষাসামগ্রী এবং পেশাদার গাইড ছাড়া এই মরুভূমিতে প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই পর্যটন কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সচেতনতাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যাতে চরম পরিবেশেও ভ্রমণকারীরা নিরাপদ অভিজ্ঞতা পান।

রুব' আল খালি শুধু একটি শূন্য মরুভূমি নয়, এটি পরিবেশবিজ্ঞান ও জলবায়ু গবেষণার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এখানে খরা, বালিয়াড়ির গঠন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং জীববৈচিত্র্যের অভিযোজন নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মরুভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বোঝা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিতে পারে।

রুব' আল খালি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য প্রতীক। শত শত বছর ধরে এটি মানব সভ্যতার কাছে রহস্যময়তার প্রতীক হয়ে আছে। একদিকে এটি প্রকৃতির চরম চ্যালেঞ্জের গল্প বলে, অন্যদিকে আরবের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আজও এর আকর্ষণ অটুট, যা ভ্রমণকারীদের বিমোহিত করে এবং গবেষকদের নতুন নতুন তথ্য অনুসন্ধানে উৎসাহিত করে।

রাজু

×