ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২ শ্রাবণ ১৪৩২

রাজহাঁস ‘রাজা’ ও কৃষক জাকির: নিঃশব্দ এক হৃদয়ের বন্ধন

মো. তানভীর হাসান, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ফেলো- বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট 

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ২৭ জুলাই ২০২৫

রাজহাঁস ‘রাজা’ ও কৃষক জাকির: নিঃশব্দ এক হৃদয়ের বন্ধন

ভাষাহীন প্রাণ, কিন্তু হৃদয়ভরা বন্ধুত্ব। ছবিঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

যখন মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট ঘনীভূত, সম্পর্ক সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ভার্চুয়াল পর্দার আবদ্ধ জগতে, তখন পিরোজপুরের এক মেঠোপথ ঘেরা গ্রামে গড়ে উঠেছে এক বিস্ময়কর হৃদ্যতা। সেই সম্পর্ক না কোনো রক্তের, না কোনো ভাষার,বরং তা গড়ে উঠেছে এক দরিদ্র কৃষক আর একটি রাজহাঁসের মধ্যকার নিঃশব্দ ভালোবাসার বন্ধনে।

পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার পূর্ব যুগিয়া গ্রামের কৃষক জাকির হোসেন। প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ত থাকেন ক্ষেতে, বাজারে কিংবা চায়ের দোকানে। কিন্তু তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেই একটি অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ছায়ার মতো থেকে যায়। সে হলো একটি রাজহাঁস, যার নাম ‘রাজা’।

দেখলে মনে হবে, রাজা যেন শুধু একটি হাঁস নয় একজন জীবন্ত সঙ্গী, যে জাকির হোসেনের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
জাকির ডেকে বললেই সাড়া দেয় রাজা, পেছনে ছুটে চলে। সকাল হোক কিংবা গভীর রাত,দোকানে, বাজারে এমনকি গ্রামের স্কুল মাঠেও দেখা যায় দু’জনের একসাথে হাঁটাচলা। হাঁসটির চালচলন, আচরণ এমনই মানবিক যে, এলাকার মানুষ প্রায়শই বলেন, “এটা হাঁস না, মানুষ।”

জাকির বলেন,''রাজা বললেই চলে আসে। দোকানে চা খেতে বসে। বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। এমনকি কখনো বিছানায় মলমূত্র করে না। আমি ওকে ছাড়া যেন একাকী।"

এই অদ্ভুত আচরণেই কৌতূহলী হয়েছে গ্রামবাসী। স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন,“জীবনে অনেক হাঁস দেখেছি। কিন্তু এমন হাঁস দেখিনি। ও যেন সব বোঝে, মানুষের মতো আচরণ করে। জাকির ভাইয়ের জীবনের ছায়াসঙ্গী হয়ে গেছে।”

এ সম্পর্কের পেছনেও আছে এক বিষাদমাখা গল্প। প্রায় এক বছর আগে কাউখালী হাট থেকে দুটি হাঁস কিনেছিলেন জাকির। কয়েকদিন পর একটি মারা যায়। দ্বিতীয় হাঁসটি একাকীত্বে ভুগছিল। ধীরে ধীরে সে ঘনিষ্ঠ হয় জাকিরের সঙ্গে। সময়ের পরিক্রমায় সেই হাঁস হয়ে ওঠে এক নিঃস্বার্থ আত্মিক বন্ধুর প্রতীক।

জাকির মনে করেন, রাজার মধ্যে রয়েছে এক অলৌকিক সত্তা। হাঁসটি চোখের ভাষা বোঝে, দুঃখ অনুভব করে, এবং জাকিরের নিঃসঙ্গ হৃদয়কে প্রতিনিয়ত সঙ্গ দেয়।

“ওর চোখের দিকে তাকালেই মনে হয়, সে কিছু বলতে চায়। আমি যেন একটা প্রাণ না, একটা আত্মার সঙ্গে কথা বলি,”- বললেন জাকির।

এই অনন্য সম্পর্ক ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।জাকির ও রাজার প্রতিদিনের ছবি, ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। হাজারো মানুষ কমেন্টে লিখেছেন, “মানুষ যেখানে সম্পর্ক ভাঙে, সেখানে এক হাঁস এমন করে ভালোবাসে এটাই বিস্ময়।”

একটি ভাষাহীন প্রাণ কীভাবে একজন মানুষকে অবলম্বন করে, কীভাবে সম্পর্কের সুর বাঁধে জাকির ও রাজা সেটার জীবন্ত প্রমাণ। যেখানে মানুষ-মানুষের সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে অর্থ আর স্বার্থে, সেখানে এই বন্ধুত্ব সমাজের জন্য রেখে যাচ্ছে এক অনন্য বার্তা।

রাজা এখন শুধু জাকির হোসেনের নয়,সে হয়ে উঠেছে আশার প্রতীক, ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি, এবং নিঃশব্দ এক আত্মার বন্ধন, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কোনো শব্দের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় শুধু একটি হৃদয়, একটুখানি সময়, আর নিঃস্বার্থ সঙ্গ।

নোভা

×