
বিশ্বজুড়ে তাপপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী ও তীব্র হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে শীতলকরণের প্রয়োজনীয়তা দ্রুত বেড়ে চলেছে, যা শুধু বিদ্যুৎ বিলেই নয়, বৈশ্বিক বিদ্যুৎ গ্রিড ও পরিবেশের ওপরও ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। ২০২৪ সাল ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণ বছর হিসেবে রেকর্ড হওয়ার পর ২০২৫ সালও তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। এখন অনেকের কাছে এয়ার কন্ডিশনার আর বিলাসিতা নয়, বরং জীবনের জন্য অপরিহার্য।
কীভাবে কাজ করে এয়ার কন্ডিশনার?
এয়ার কন্ডিশনার ঘরের উষ্ণতা কমিয়ে ঠান্ডা রাখে। এটি রেফ্রিজারেন্ট নামক রাসায়নিক তরলের সাহায্যে ঘরের ভেতরের গরম বাতাস বাইরে বের করে দেয়। এ প্রক্রিয়ায়, গরম বাতাস ইনডোর ইউনিটে প্রবেশ করে ঠান্ডা ইভাপোরেটর কয়েল এর উপর দিয়ে যায়। কয়েলের ভিতরে থাকা তরল রেফ্রিজারেন্ট তাপ শোষণ করে গ্যাসে পরিণত হয় এবং বাতাস ঠান্ডা হয়ে ঘরে ফেরত যায়।
এরপর গরম রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস বাইরে থাকা কমপ্রেসরে প্রবেশ করে যেখানে তা উচ্চচাপ ও উচ্চতাপে রূপান্তরিত হয়। এরপর কনডেনসার কয়েল এর মাধ্যমে এই গরম গ্যাস বাইরে তাপ ছেড়ে তরলে পরিণত হয় এবং চক্রটি আবার শুরু হয়।
এয়ার কন্ডিশনারের ইতিহাস
১৮২০ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফারাডে প্রথম আবিষ্কার করেন যে অ্যামোনিয়া গ্যাস সংকোচন ও বাষ্পীকরণ করলে বাতাস ঠান্ডা হয়। ১৮৩০-এর দশকে ড. জন গোরি ফ্লোরিডায় একটি মেশিন তৈরি করেন যা বরফ তৈরি করে হাসপাতালের কক্ষ ঠান্ডা করত।
আধুনিক এয়ার কন্ডিশনের সূচনা ঘটে ১৯০২ সালে, যখন আমেরিকান প্রকৌশলী উইলিস ক্যারিয়ার নিউ ইয়র্কের একটি প্রিন্টিং প্রেসে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র তৈরি করেন। ১৯১৪ সালে মিনিয়াপলিসের একটি বাসায় প্রথম রেসিডেনশিয়াল এসি স্থাপন করা হয়, যার আকার ছিল পুরো একটি কক্ষের সমান।
১৯৩১ সালে প্রথম জানালায় বসানো ইউনিট তৈরি করেন শুল্টজ ও শেরম্যান, যা শহুরে আবাসিক ব্যবহারে জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে এসি ব্যবহারে ব্যাপক বিস্তার ঘটে। যুদ্ধোত্তর সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শহরায়ণের কারণে এটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৭০ ও ৮০-র দশকে জাপানে ডাক্টলেস মিনি-স্প্লিট এসি ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়, যা পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। একই সময়ে ইনভার্টার প্রযুক্তিও জনপ্রিয় হয়, যা কম্প্রেসরের গতি নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করে।
৯০-এর দশকে পরিবেশগত উদ্বেগ ও উচ্চ বিদ্যুৎ মূল্যের কারণে বিভিন্ন দেশ এনার্জি ইফিশিয়েন্সি স্ট্যান্ডার্ড চালু করে। এই সময় CFC নিষিদ্ধ করা হয় এবং তার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় HFC (যেমন R-134a)। যদিও HFC ওজোন স্তর ধ্বংস করে না, তবে এটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায়।
সঠিক এসি কিভাবে বাছাই করবেন?
সঠিক ক্ষমতার এসি নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি। ছোট এসি বড় ঘরে কাজ করতে পারবে না, আবার অতিরিক্ত বড় এসি ঘর খুব দ্রুত ঠান্ডা করে ফেলে কিন্তু আর্দ্রতা দূর করতে ব্যর্থ হয়।
বিবেচ্য বিষয়:
-
ঘরে সূর্যের আলো ঢুকছে কি না
-
সিলিং-এর উচ্চতা
-
ঘরে কয়জন থাকছে
-
কম্পিউটার বা টিভি চালু আছে কি না
কীভাবে এসি রক্ষা করবেন ও বিদ্যুৎ সাশ্রয় করবেন
রক্ষণাবেক্ষণ টিপস:
-
থার্মোস্ট্যাট খুব কম রাখবেন না
-
এয়ার ফিল্টার পরিষ্কার রাখুন
-
এসিকে মাঝে মাঝে বিশ্রাম দিন
-
ঘন ঘন চালু–বন্ধ করবেন না
-
বাইরের ইউনিট ছায়ায় রাখুন
বিদ্যুৎ সাশ্রয় টিপস:
-
প্রোগ্রামেবল থার্মোস্ট্যাট ব্যবহার করুন
-
সিলিং ফ্যান চালু রাখলে থার্মোস্ট্যাট ৪ ডিগ্রি বেশি রাখা যায়
-
জানালা ও ফাঁক বন্ধ রাখুন
-
গরম যন্ত্রপাতি এড়িয়ে চলুন
-
পর্দা টেনে রাখুন
-
রান্না বা গরম পানিতে গোসলের সময় এক্সহস্ট ফ্যান চালান
এয়ার কন্ডিশনার ও বৈশ্বিক উষ্ণতা
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (IEA) অনুযায়ী, ২০২২ সালে এসি ও ফ্যান ব্যবহার করে বিশ্বে প্রায় ২,১০০ টেরাওয়াট-ঘণ্টা (TWh) বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে, যা মোট বৈশ্বিক বিদ্যুৎ ব্যবহারের ৭%। শুধু ভবন খাতে শীতলকরণেই ২০% বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়েছে।
এর ফলে ২০২২ সালে এসি ব্যবহারে কার্বন নিঃসরণ হয়েছে ১ বিলিয়ন টন, যা শিল্প ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বৈশ্বিক CO₂ নিঃসরণের ২.৭%। এই হিসাব রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস থেকে নির্গত গ্রিনহাউস প্রভাব ধরা ছাড়াই।
বিশ্বজুড়ে এসি ব্যবহারের বিস্তার
উষ্ণ অঞ্চল ও শহরায়ণের ফলে এসি ব্যবহারে দ্রুত প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। শহরে কংক্রিট ও পিচের কারণে "আরবান হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট" হয়, যা শহরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
IEA জানায়, ২০১৮ সাল নাগাদ জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এসি ব্যবহারে সর্বজনীনতা এসেছে। তবে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এসি এখনও সীমিত। ভারতে মাত্র ১৩% এবং ইন্দোনেশিয়ায় ২০% ঘরে এসি আছে, তবে এই প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে।
নিজে বানান এসি বিকল্প
যারা এসি কিনতে পারছেন না বা বিদ্যুৎ বিল বাঁচাতে চান, তারা সহজ উপায়ে একটি কুলার বানাতে পারেন। একটি স্টাইরোফোম বক্সে বরফ ভরে, তার উপরে ফ্যান বসিয়ে ঠান্ডা বাতাস তৈরি করা যায়। এটি আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ না করলেও তীব্র গরমে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে।
Jahan