
.
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু নিয়ে ট্রাম দুর্ঘটনার যে ঘটনাটি আছে সেটি পৃথিবীতে শুধুমাত্র জীবনানন্দের ক্ষেত্রেই ঘটেছে আর কোনো কবি এ দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। তাই অনেকের ধারণা, কেন তিনিই শুধু ট্রামে চাপা পড়ে মারা গেলেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। কেউ ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি বলে জীবনানন্দের ক্ষেত্রে সেটা ঘটতে পারবে না এমনও না।
ভূমেন্দ্র গুহ, প্রেমেন্দ্র মিত্রসহ আরো দু’একজন বলতেন, জীবনানন্দ হাঁটতেন একমনে। কী যেন ভাবতেন আর হাঁটতেন। পেছনে কে ডাকছে, সামনে কী হচ্ছে তাঁর কোনোকিছু মাথায় থাকত না। কবি মানুষ তাই ভাবনাটার মধ্যে থাকাটাই তাঁর জন্য স্বাভাবিক। প্রেমেন্দ্র মিত্র একবার কলকাতায় দেশপ্রিয় পার্কের রাস্তায় পেছন থেকে অনেকক্ষণ ধরে ডাকার পরেও জীবনানন্দ কোনো সাড়া দেননি। পেছন থেকে হাত ধরে থামানোর পর জীবনানন্দ বলেছেন-‘ও প্রেমেন!’ তাঁর অন্যমনস্কতার কারণটিই পরিষ্কার এখানে। জীবনানন্দের জীবনীকারের মধ্যে অন্যতম প্রধান গোপালচন্দ্র রায় তাঁর ‘জীবনানন্দ’ বইতে সরাসরি বলেছেন-‘অসুস্থ জীবনানন্দের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল আকাশবাণীর পুরনো বাড়িতে কবিসভায়। আমি জীবনানন্দের সেই উদভ্রান্ত অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে আহত হয়েও ভাবতে পারিনি যে, তাঁর শেষদিন আসন্ন। এই সাংঘাতিক অন্যমনস্কতাই তাঁর কাল হলো। বাড়ির সামনে তিনি ট্রামে চাপা পড়লেন।’ (জীবনানন্দ : গোপালচন্দ্র রায়, পৃষ্ঠা- ৯৩)
গোপালচন্দ্র রায় সরাসরি অন্যমনস্কতাকেই দায়ী করেছেন জীবনানন্দের মৃত্যুর জন্য।
ট্রামে চাপা পড়ার পর তাঁকে উদ্ধার করা চায়ের দোকানদার চুনিলালের বয়ান ছিল- ‘সমবেত জনতার মাঝে দু’একজনের কথা কানে এলো। তারা বলছেন, ট্রাম ঘণ্টা বাজিয়েছে, লোকজন চিৎকার করেছে কিন্তু ভদ্রলোক কিসের চিন্তায় যে এত বিভোর ছিলেন, কোনোকিছুই তাঁর কানে যায়নি।’ (জীবনানন্দ : গোপালচন্দ্র রায়, পৃষ্ঠা - ৯৬)
চুনিলালের বয়ানেও সেই অন্যমনস্কতার প্রসঙ্গই এসেছে।
২২ অক্টোবর ১৯৫৪ তারিখে জীবনানন্দের মৃত্যুতে তখনকার দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকার নিউজ যেখানে দুর্ঘটনার কথা বলা হয়েছে : ‘the youthful poet of modernism in bengali literature, sri jibanananda Das expired at 11:35 p.m. in sambhunath pandit hospital where he was admitted a fwe days back due to a serious accident. he suffered by a fall from a tram car.
অনেকে তো এটাও জানেন না যে, জীবনানন্দের ট্রাম দুর্ঘটনা হয় ১৪ অক্টোবর ১৯৫৪ তারিখে। অথচ সরাসরি ২২ অক্টোবরকেই তাঁর আত্মহত্যার দিন বলে চালিয়ে দেন অনেকেই। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর অন্যান্য দিনের মতোই কবি আনমনে ট্রাম লাইন ধরেই হাঁটছিলেন, অসুস্থ ছিলেন এবং তাঁর হাতে ডাব ছিল, এ অবস্থায় কেউ আত্মহত্যা করবে এটি যুক্তিসঙ্গত নয়। উল্লেখ্য, ট্রামলাইনে তিনি আরো হেঁটেছেন অনেকবার। সেদিন হাঁটছিলেন কিন্তু ট্রাম যে চলে এসেছে ঘাতক হয়ে সেটা ক্ষুণাক্ষরেও খেয়াল করেননি। মৃত্যুপরবর্তী সময়ে জীবনানন্দের কাছের মানুষরা কেউ আত্মহত্যার কথা বলেননি, শুধু ভূমেন্দ্র গুহ তাঁর সাক্ষাৎকারে একবার ‘হয়তো আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন’ বলেছেন কিন্তু তা হাইপোথিটিক্যাল ছিল।
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু যে দুর্ঘটনাই ছিল, এটির স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ আছে। এই প্রমাণকে মাথায় রেখেই আত্মহত্যা জাতীয় বিতর্ককে আমরা অবশ্যই ভুলে যেতে পারি।