ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কবি আবুবকর সিদ্দিক কবিতা ও কথাসাহিত্য

​​​​​​​অরবিন্দ মৃধা 

প্রকাশিত: ০০:২৪, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

কবি আবুবকর সিদ্দিক কবিতা ও কথাসাহিত্য

.

বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি জাগরণে বিংশ শতাব্দীর মধ্যগগন থেকে যে সকল মুক্তচিন্তার তেজস্বী বাস্তববাদী মানুষ বাংলা কাব্য সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে দেশও জাতির সংকটকালে অমিততেজে কাজ করেছেন, তাদেরই একজন বিপ্লবী চেতনার কবি, গণমানুষের ভাষ্যকর, কথাশিল্পী, আবুবকর সিদ্দিক (; ১৯ আগস্ট ১৯৩৬ মৃত্যু; ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩) দীর্ঘ ৮৭ বছরের যাপিত জীবনে, বলা যায় ৭০ বছর ধরে ছাত্রজীবন থেকে অধ্যাপনা জীবন, অবসর জীবনেও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিকর্মী হিসেবে সাহিত্যে আধুনিক কাব্য, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, সংগীত, স্মৃতিকথা লিখে নিজস্ব শিল্পস্বত্বায় দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন।

জন্ম বাগেরহাট জেলার গোটাপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে। পৈত্রিক নিবাস একই জেলার ভৈরব নদের পারে বৈটপুর গ্রাম। পিতা মতিয়র রহমান পাটোয়ারী, মায়ের নাম মতিবিবি, স্ত্রী আনোয়ারা সিদ্দিক। দুই ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি।

ভাই-ওমর আলী, বোন- ফাতেমা বেগম, জাহানারা বেগম এবং সাহানা বেগম। তিনি ছয় সন্তানের জনক মেয়ে বিদিশা সিদ্দিক, মণিষা, তৃষা, বিপাশা পিয়া, একমাত্র ছেলে সোয়েব সাম্য সিদ্দিক।

এক. আবুবকর সিদ্দিকের পিতা ছিলেন ব্রিটিশের সরকারি চাকরিজীবী।

পিতার চাকরির সুবাদে তাকে শিশুকাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের হুগলি এবং বর্ধমানে অবস্থান করতে হয়। তিনি বর্ধমান টাউন স্কুল/বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলে (?) সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। আশৈশবে তিনি ঢ়াড়ী জনপদের সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। দেশ ভাগের ফলে তিনি নিজ জেলা বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে ১৯৫৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ৫৬ সালে স্নাতক পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

দুই. শিক্ষা শেষে বরিশালের চাখার ফজলুল হক কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে খুলনার বি এল কলেজ, বাগেরহাটের পিসি কলেজ, কুষ্টিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। পরে ঢাকা নটরডেম কলেজে দুবছর এবং কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর শিক্ষকতা করেন। এই দীর্ঘ শিক্ষা কর্মজীবন এবং জীবৎকাল পর্যন্ত আজকের আলোচ্য কবি আবুবকর সিদ্দিক কাব্য, সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে বিরতিহীনভাবে কাজ করেছেন, নানা পরিবেশের মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন, উপলব্ধি করেছেন, পড়েছেন, লিখেছেন, সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্যভান্ডার। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন আদর্শ, অনুকরণীয়, শিক্ষার্থীবান্ধব, সাহিত্য অধ্যাপক।

তিন. বর্ধমান শহরে অবস্থানকালে কিশোর আবুবকর সিদ্দিক রাজনৈতিক, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক দর্শনে শাণিত হন। লেখক হওয়ার গোড়ার কথা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ওখানে (বর্ধমান) থাকার ফলে রাজনৈতিক আবহের ভেতরেই বিকশিত হয়েছি। তখন নেতাজী সুভাষ বসু আমাদের কিশোরদের আরাধ্য নেতা। স্কুল থেকে বন্ধুদের কাছ থেকেজয় হিন্দবলে বিদায় নিতাম। আর কংগ্রেস ফরোয়ার্ড ব্লকের রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিও ছিল অতিরিক্ত ঝোঁক। বর্ধমান শহরের টাউন হলের রাজনৈতিক সভায় যে চারজন কিশোর উদ্বোধনী সংগীত গাইতো, আমি ছিলাম তাদেরই একজন। নেহেরু-গান্ধীর জনসভায় থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই তখন কংগ্রেসের মিছিলে কিশোর বাহিনীতে থেকে আন্দোলনে অংশ নিয়েছি, স্লোগান দিয়েছি। তাছাড়া আমার বাবা ছিলেন রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক সচেতন একজন মানুষ। নেহেরু-গান্ধী-সুভাষ বোসের দর্শন, বিশ্বযুদ্ধের চাপ, ’৭৬-এর মন্বন্তর, দাঙ্গার মতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে ফিরে এলাম জন্মভিটে বাগেরহাটের বৈটপুর গ্রামে। আর সমস্ত কিছুই পরবর্তীতে আমার লেখক হয়ে ওঠার ভিত্তি রচনা করেছে।তাঁর লেখার প্রথম প্রকাশ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘১৯৪৬ সালে বর্ধমান কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সাত্তার সম্পাদিতবর্ধমানের কথা পুজো সংখ্যায় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ পায়। ঠিক ওই সময়টাতেই আমার একটি গল্প স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়। থেকে বুঝা যায়, কিশোর বয়সেই আবুবকর সিদ্দিক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক দর্শনে শাণিত হয়েছেন ইস্পাত কাঠামোয়।

চার. তাঁর কবিতায় শব্দশৈলী, বিষয়নির্মাণে বিচিত্রতা, ভিন্নমাত্রিক স্বর ফুটে উঠেছে। কাব্যচিন্তায় আধুনিকতা, যাপিত জীবন পরিবর্তনের সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে স্পষ্টবাদ, পরিশীলিত কাব্য, নিজস্ব শব্দ নির্মাণ কবির কাব্যচরিত্রে ফুটে উঠেছে। গণমানুষের কথা, ব্রাত্যজনের কথা, বিভিন্ন জনপদের লোকজ ভাষার শব্দসম্ভার যেন ডংকা বাজিয়ে চেতনায় আঘাত হেনেছে। তিনি কলম হাতে বিশ্বজয়ের পথে হেঁটে বলেছেন, ‘খুব কৃশ ঋজু কলম একটি, এই নিয়ে বিশ্বজয়ে বেরিয়েছি আমি একা একা তীরন্দাজ।যদি বলে যোগী আমি/তাইই/সাহিত্যযোগী এক/গদ্যপদ্য উপজীবী আমি প্রতিক্ষণিক শ্রমিক।

অভিব্যক্তি আমাদের জানান দেয় দেশ কাল সমাজ রাষ্ট্রের বৈষম্য, দৈন্য, বিভেদ, প্রাকৃতিক বৈরীরূপের ছোবল আবুবকর সিদ্দিকের চেতনায় যে ভাব জাগিয়েছিল, তাঁর হৃদয়ক্ষরণ যন্ত্রণার বহির্প্রকাশ ঘটেছে লেখনীর মধ্যদিয়ে।

পাঁচ. ১৯৫০-এর দশক থেকে সিকান্দার আবু জাফরেরসমকালসাহিত্য পত্রিকায় লেখার সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের সুধীমহলে আবুবকর সিদ্দিকের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কবি শামসুর রাহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আল মাহমুদ, আবুহেনা মোস্তফা কামাল সহযাত্রী কবিগণ মেধা-মননে স্বকীয় ছিলেন।

ধারায় আবু বকর সিদ্দিক তাঁর গদ্যপদ্যে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর।  কলকাতারসাহিত্যপত্র’, ‘সপ্তাহ’, দর্পণ, পরিচয়তে তাঁর লেখা ছাপা হতো। এই লেখা থেকে ভালোবাসার জোরে ত্রিশের দশকের পঞ্চপা- নামে খ্যাত, কবিতার এক মহীরুহ, কবি বিষ্ণু দের সঙ্গে ১৯৬৩ সালে উদীয়মান কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাক্ষাৎ সক্ষ্য গাঢ় হয়ে ওঠে। উভয়ের মধ্যে হয়েছে অন্তরঙ্গ পত্রালাপ। বিষ্ণু দে তাঁরসংবাদ মূলত কাব্যনামক কবিতার বইটি বাংলাদেশের কবিআবুবকর সিদ্দিক এবং শামসুর রাহমান’-এর নামে উৎসর্গ করেন। বিষয়ে আবুবকর সিদ্দিক উল্লেখ করেছেন, ‘বুঝতে পারি, গণ-আন্দোলনের সড়ক ধরে ক্রমজায়মান একটি স্বাধীন দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে শামসুর রাহমান বা আমি তাঁর কাছে প্রতীকী চরিত্রে পরিণত হয়ে উঠেছিলাম।অর্থাৎ কবির সাহিত্যকর্ম যে গণ-আন্দোলন থেকে পরবর্তীতে স্বাধীন দেশের সর্বপ্রকার জনস্বার্থের আন্দোলনে আবর্তমান ছিল, সেটি বুঝতে অসুবিধা হয় না।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আবুবকর সিদ্দিকের কাব্য-সাহিত্যের লিখনশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে //৮৮ কবিতায় জানিয়েছেন;

ভালোবাসা দিয়ে আমি তোমার সর্বাঙ্গ মুড়ে দেবোফুলে কাঁটায় আমি তোমার সর্বাঙ্গ মুড়ে দেবো,

যাতে ফুল পেতে গেলে আমিও কাঁটায় বিদ্ধ হই,

অন্য কোনো অন্ধ চোখ কেবলি কাঁটার কাঁটা খাবে।

সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়জলরাক্ষসখরাদাহউপন্যাস দুটি সমালোচনা করে ২৯//৮৭ তারিখে এক পত্রে আবুবকর সিদ্দিককেশক্তিমান ঔপন্যাসিকবিশেষণে ভূষিত করে বলেছেন, ‘আপনার লোহার কলম অটুট থাক।কথা তার কাব্য-সাহিত্যে নতুন রূপে চিত্রিত হয়েছে। ব্রাত্যজন তার গল্প উপন্যাসভূমিহীন দেশ’ ‘চরবিনাশকাল’ ‘খরাদাহ’ ‘জলরাক্ষস’ ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’- প্রধান চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার সাহিত্যকর্মকে ঘিরে কবি-সাহিত্যিকদের উদ্দীপনা আগ্রহের শেষ নেই।

আবুবকর সিদ্দিকের ৭৫ বর্ষপূর্তি সম্মাননা সংখ্যাস্বপ্নকুঁড়িগ্রন্থে কবির সাহিত্যসম্ভারের নানা দিক আলোচনা পর্যালোচনা করে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে তাঁর সমকালীন বন্ধু, সহযোদ্ধা, ছাত্রপ্রতিম কবি-সাহিত্যিকগণের মধ্যে লিখেছেন- সৈয়দ শামসুল হক, কবীর চৌধুরী, খান সরোয়ার মুরশিদ, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কামাল লোহানী, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, হাসনাত আব্দুল হাই, খন্দকার সিরাজুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ তোসারফ আলী, পিনাকী রজ্ঞন গুহ, ইজাজ হোসেন, শিহাব সরকার, আতা সরকার, নাসির আহমেদ, তসিকুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, আরিফুল হক কুমার, মাহমুদ কামাল, আযাদ কামাল, . সালিম সাবরিন, মামুন মুস্তাফা, . মিল্টন বিশ্বাস, শহীদ ইকবাল, হামীম কামরুর হক সাক্ষাৎকার অনিকেত শামীম।

ছয়. আবু বকর সিদ্দিক কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথায় নিজস্ব আধুুনিকতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও একজন অদ্বিতীয় গণসংগীত রচায়ক, যশস্বী কবি, শক্তিমান কথাসাহিত্যিক-শব্দতাঁতি। তাঁর জীবনমুখী গণগান, ভাষার গান অন্যান্য গানের স্তরে স্তরে স্পষ্টতার ছাপ বিদ্যমান। তিনি যেমন ছিলেন একজন মনস্তাত্ত্বিক, সংগঠক, তেমনই ছিলেন গণমানুষের মিছিলে, মঞ্চে, শহীদ মিনারে আবার গ্রামগজ্ঞের পরিব্রাজক। তাঁর লক্ষ্যভেদী দৃষ্টিতে কোনো কিছু এড়ায়নি। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শব্দ সৈনিক; সর্বোপরি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সময়ের পদচারণায় বঞ্চনা, অনিয়ম, অন্যায়ের প্রতিবাদ প্রতিরোধে সোচ্চার মসি সৈনিক; বঞ্চিত, ব্রাত্যজনের কণ্ঠস্বর। একজন বিপ্লবী শব্দসৈনিক।

বেরিকেট বেয়োনেট বেড়াজাল, পাকে পাকে তড়পায় সমকাল সংগীতটিতে তিনিকমরেড কবিয়ালভণিতায় নিজেকে চিহ্নিত করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গান মুক্তিযোদ্ধাজনতাকে প্রতিনিয়ত উদীপ্ত করেছে। গানের কারণে রাজাকার আলবদরদের গুলি থেকে বেঁচে গেলেও চরম নির্যাতনের শিকার হন। তাঁর ডান হাত মুচড়ে দেয়।

লক্ষ মানুষ যদি গর্জে ওঠে, গুরু গুরু রণধ্বনি কেমন শোনায়। লক্ষ হাতে যদি ওঠে হাতিয়ার, ঝলসিতে রোদ্দুরে

কেমন শানায়। গান শরণার্থী ক্যাম্পে পথে পথে কালীপদ দাসসহ অন্য শিল্পীদের কণ্ঠে গীত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা কজন আধা আধা আধুনিক নাগরিক, ইঞ্চি ইঞ্চি ধুঁকে ধুঁকে স্বপ্ন দেখি সাগরিক’,ওরা নতুন ইহুদি ওরা নতুন বর্গী/ওরা তৈমুরের পুরুষ ওরা চেংগিসের বংশ’/: হোই আইনুলভাই জয়নুলভাই কই গেলি রে,/হেই মাটিবেটি ডাক দিয়েছে রূপ মেলিরে:/‘বারে বারে সর্বনাশা ভ্রান্তিতে/তোমার আমার মোকাবেলা ক্রান্তিতে।কুৎসা কূটকলঙ্কের কর্দমে/বন্ধুগণ মত্ত বিপুল উদ্যমেসম্রাজ্যবাদী চোরা কারসাজিটা দেখো মিয়ারাঙামুখো মার্কিনীদের ঠিকঠাক চিনে নাও/ছদ্মদরবেশ মুখোশ হ্যাঁচকা টানে খুলে দাওবহুরূপী মুখোশের চিনে নাও এই বার/ মুনাফার লুটেরা দাগিদের করো বারবিশ্বব্যাপী সর্বহারার একটি মুক্তিমন্ত্র/কিষাণমজুর দুস্থ দলের দিশারী সমাজতন্ত্র এরূপ বলিষ্ঠ শব্দজালে বাঁধা রুদ্র স্বর বিক্ষুব্ধ সুরের গণগান নিয়ে বিশ শতকের ষাটের দশকে, স্পষ্টবাদী কমরেড কবি, শক্তিমান কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। দুই শতাধিক জাগরণ মূলক, দেশ, ভাষার গণসংগীতসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ছয় শতাধিক গান তিনি রচনা করেছেন। ৬০ এর দশকজুড়ে গণজাগরণ, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে তার গণ দেশগান গণমানসে চেতনা জাগরণে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা *একুশের ভোরে জেগে ওঠে দেখি রক্ত/রক্তিম সূর্যের ফিনকি ‘(সুরকার শেখ লুৎফর রহমান)* বাংলা আমার দুঃখ-সুখের সাথী মধুর ভাষা’ (সুরকার উস্তাদ আকতার ছাদমানী) *স্বাধীনতা নামে এক সূর্যের পি- ‘(সুরকার, শেখ লুৎফর রহমান) *কত মৃত্যু কত অভিশাপ গানের সুরকার রাজশাহীর আব্দুল আজিজ বাচ্চু। *পৎ পৎ উৎসাহে পতাকাটা উড়ছে গানে সুর দিয়েছেন, কবির সহপাঠীবন্ধু সংগীতজ্ঞ নাসির হায়দার।

*শবমেহেরের সবের পরে, *কেন মা তুই জনম দিলি বিশ্বেপুরুষ মকলুকাৎ, *কালো কালো মেহনতী পাখি গানগুলোর সুরকার শিল্পী বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর।

শিল্পী সাধন সরকার ছিলেন, কবি আবুবকর সিদ্দিকর গানের ভা-ারি। তার গণগান, মুক্তিযুদ্ধের গান, একুশের গানসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বহু গানে সাধন সরকার সুর দিয়েছেন। হারিয়ে গেছে অনেক। তার সংগীতগ্রন্থরুদ পদাবলীগণমানুয়ের গান বইয়ে সাধন সরকারকৃত পঁচিশটি স্মরলিপি আছে।

সাত. দ্রোহের কবি, জীবনমুখী কবি আবুবকর সিদ্দিক সময়ের দাবিতে তাৎক্ষণিকভাবে অনেক গান লিখেছেন, সেসব গণগান কবির গড়া সাংস্কৃতিক সংগঠন বাগেরহাটেরচারণিকসংগঠনে শিল্পী সঞ্চিতা, কাজী তারিক, অজ্ঞলী দাশ, হোসনয়ারা মিনু, সেলিম, বাবুল মিহিনারা গেয়েছেন। কবিবন্ধু কামাল লোহানীর সাংস্কৃতিক সংগঠনক্রান্তি’, খুলনারসন্দীপন গোষ্ঠীর শিল্পীরা ৬০ও৭০ এর দশকে মঞ্চে, মাঠে, সমাবেশে পরিবেশন করেছেন।

ধীমান সুরকার শেখ লুৎফর রহমান এর সুরে*পায়রার পাখনায় বারুদের বহ্নিজ্বলে, *মার্কিনী লাল ইয়াং কিরা চায় কি হে

*বিপ্লবের রঙেরাঙা ঝান্ডা ওড়ে আকাশে তিনটি গান ১৯৬৮তেক্রান্তি শিল্পীরা তৎকালীন পাক-চীন মৈত্রী সমিতি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেন।

প্রমিত শব্দের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদের প্রাকৃত গণমানুষের মুখে প্রচলিত শব্দ; শব্দচাষি কবি আবুবকর সিদ্দিক রচিত গীত, কবিতা, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধে বলিষ্ঠভাবে স্থান পেয়েছে। বাংলা কাব্যসাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত।

আবুবকর সিদ্দিক এর বহু গণসংগীত কণ্ঠে নিয়েছেন, সংগীতজ্ঞ কালীপদ দাস (স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত) তিনি ছিলেন তার গানের আর এক কা-ারি।

* তাঁরই জন্মের ছাড়পত্রে লেখা ছিল সংগ্রাম

* অশান্ত এক জীবনের পরিনাম*

শোন একটি একুশ আাসে চেতনার সৈকতে

* সম্রাজ্যবাদীর চোরা কারসাজিটা দেখো মিয়াগানসহ কয়েকটির সুর দিয়েছেন, প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী মিনা মিজানুর রহমান।

* হোই আইনুলভাই জয়নুলভাই, কই গেলি রে,*কান পেতে শোনো, তুমি কান পেতে শোনো,

* জয়-বাংলার/জয় কবিতার গানে মোদিও সুর সংযোজন হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে কবির গানে কণ্ঠ দিয়েছেন, সংগীতশিল্পী শাম্মী আক্তার, ভারতী ঘোষ, আজমল হোসেন, শেখ আব্দুস সালাম, বাদল দত্ত, প্রদীপ রাহা আরও অনেকেই।

১৯৬০এর দশকজুড়ে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকগণ রাজপথে নেমেছেন। আবুবকর সিদ্দিক তখন বাগেরহাট পিসি কলেজে অধ্যাপনা করেন, মাঝেমাঝে তার শিল্পীবন্ধু সাধন সরকারের খুলনার মির্জাপুরের বাসায় আসতেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘১৯৬৪ সালের ২৭ অক্টোবর বিকেলবেলাবিখ্যাত ফ্লোরা হাউস (এখনকার অভিজাত হোটেল ওয়েস্টার্ন-ইন) (আহসান আহম্মদ রোডের মিলনবিন্দুতে) এর তিন তলায় সদ্য জন্ম নেওয়া সন্দীপন সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়ের অফিস।এইসন্দীপনগোষ্ঠীনামে সাংস্কৃতিক সংগঠনের বরেণ্য একঝাঁক সংগ্রামী সংস্কৃতিযোদ্ধার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দীপ্ত পথচলা শুরু হয়। এঁদের পুরোধা ছিলেন অধ্যাপক খালেদ রশীদ (গুরু), হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহমুদ, মোস্তাফিজুর রহমান, সাধন সরকার প্রমুখ। এঁদের মধ্যে শাসকবিরোধী চাপা উত্তেজনা, মাকর্সবাদী প্রেরণায়, নাজিম মাহমুদ লেখা এবং সাধন সরকারের সুরকরা সন্দীপনের সম্প্রদায় সংগীত কবি আবুবকর সিদ্দিককে উদ্বেলিত করে তোলে।

তিনি বলেছেন, ‘সেদিন বিদ্রোহ বিপ্লবের অগ্নিসম্ভাবনা আমারও স্নায়ুতে আগুন ধরিয়ে দেন।নাজিম মাহমুদের গানের ঈষৎ কেঠো শব্দগুলো আবেগকে ধরে রাখতে পারছিল না। প্রচ- অতৃপ্তি, দারুণ অস্বস্তি। এই দ্রোহ থেকে কবির কলমহাতিয়ার থেকে বহু গণসংগীত সৃষ্টি হয়েছে।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অন্যতম গণসংগীত রচায়ক শিল্পী সলিল চৌধুরী ঢাকায় এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়।

বেরিকেড বেয়োনেট বেড়াজালগানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। গণসংগীতের আর এক কান্ডারি হেমাঙ্গ বিশ্বাস আবুবকর সিদ্দিকর গণসংগীতের শব্দচয়ন শিল্পশৈলীতে অভিভূত হয়েছেন, একটু কঠিন হলো কিনা ভেবে; কিন্তু শব্দের শক্তিমত্তায় নিজেই আস্বস্ত হয়েছেন।

আট. ’৭১-এর যুদ্ধকালব্যাপী নিজ এলাকায় আত্মগোপনে থেকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মসিযুদ্ধ করেছেন তিনি। একদিনের যুদ্ধ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেনসুপারি বাগানে সেঁদিয়ে যাই টর্চ-খাতাকলম ট্রানজিস্টার নিয়ে। শেষ রাতে বে-মরতার (গ্রাম) দিক থেকে মুহুর্মুহু মেশিনগানের শব্দ ভেসে আসে। রাস্তার হাবড়কাদা ভেঙে হড়াৎ হড়াৎ শব্দ তুলে কারা ছুটে যায়? মুক্তি না রাজাকার? শটিপাতার আড়ালে টর্চ জ্বেলে পরপর গান লিখে চলি- * ‘আজ যুদ্ধ/ যুদ্ধ যুদ্ধকোটি/মৃত্যুমন্ত্রে রুদ্র/ বাংলার মুক্তিযুদ্ধ।

*দরদর বিপ্লব বাংলার বুকজুড়ে/বিশ্বের নিঃস্বের যুদ্ধ এখানেই আবুবকর সিদ্দিক সার্থক মসিযোদ্ধ। একারণেই তার গানে ধ্বনিত হয়েছে, ‘কড়া হাতে ধরে আছি কবিতার; হাতিয়ার কলমের তলোয়ার।

নয়. কথাশিল্পী আবুবকর সিদ্দিকর সাহিত্যকর্ম একটি বিশাল ভা-ার। সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী তার ৫৩টি গ্রন্থ যাবতকালে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ-২২টি, গল্পগ্রন্থ-১৫টি, উপন্যাস-৪টি, প্রবন্ধগ্রন্থ- ২টি, সংগীতগ্রন্থ ১টি, ছড়াগ্রন্থ- ১টি, গবেষণা; ১টি, স্মৃতিকথা গ্রন্থ- ৩টি। সম্পাদিত গ্রন্থ ১টি। রচনাসমগ্র- ২টি।

×