ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জিলহজ্জের দশ দিন, ত্যাগ, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির মহাকাব্য

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর

প্রকাশিত: ১০:২৫, ২৬ মে ২০২৫; আপডেট: ১০:৩১, ২৬ মে ২০২৫

জিলহজ্জের দশ দিন, ত্যাগ, তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির মহাকাব্য

সময়ের ঢেউয়ে ভেসে চলে একের পর এক মাস, কিন্তু কিছু মাস হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিছু সময় আল্লাহর এমন বিশেষ রহমত বহন করে নিয়ে আসে, যা আলোকিত করে জীবনের আড়ালে থাকা আত্মিক অন্ধকার। তেমনই এক মোবারক সময়—জিলহজ্জ মাস। এটি কেবল হিজরি বছরের একটি মাস নয়, এটি এক আত্মিক জাগরণের আহ্বান, তাকওয়ার আলোকিত দরজা।

এই মাসের প্রথম দশ দিন যেন একেকটি দীপ্তিময় নক্ষত্র। প্রতিটি দিন বহন করে আসমানি কল্যাণ, প্রতিটি রাত আবেগ ও নৈকট্যের স্রোতে উদ্বেলিত। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এই দশ দিনের প্রতি শপথ করে বলেন: “শপথ ফজরের, এবং দশ রাতের।” (সূরা আল-ফজর: আয়াত ১-২)

তাফসিরবিদরা বলেন, এখানে উল্লেখিত 'দশ রাত'—জিলহজ্জের প্রথম দশ দিন। আর আল্লাহর শপথ ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্ববহ হয় না, যতক্ষণ না সে বিষয়ের গুরুত্ব সীমাহীন হয়। তাই বুঝতে হয়, এই দশ দিনের ফজিলত কত বিশাল, কত মহিমান্বিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহর কাছে এমন কোনো দিন নেই, যেদিনের আমল জিলহজ্জের প্রথম দশ দিনের আমলের চেয়ে অধিক প্রিয়।” (সহীহ বুখারী)

এই দশ দিনে করা প্রতিটি ইবাদত—হোক তা নফল নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, রোজা বা সদকা—তা যেন বহুগুণে বাড়ানো সওয়াবের দরজার মতো খুলে যায়। এমনকি এই সময়ের আমলের তুলনায় জিহাদও পিছিয়ে পড়ে, যদি না কেউ নিজ জান-মাল আল্লাহর পথে দিয়ে শহীদ হয়। এই দশকের অন্তরালে রয়েছে এক মহিমান্বিত দিন—আরাফা। জিলহজ্জের ৯ তারিখে আরাফাতের প্রান্তরে হাজীরা আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে যে কান্না, যে তাওবা, যে নরম আত্মসমর্পণের দরজা খুলে দেন, তা শুধু মক্কার সীমায় আটকে থাকে না—তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ার প্রতিটি মু’মিন হৃদয়ে।

এই দিনে যারা রোজা রাখে, তাদের জন্য নবীজি (সা.) আশ্বাস দিয়েছেন: “আমি আশা করি, আরাফার রোজা আগের এক বছর এবং পরের এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেয়।” (সহীহ মুসলিম)

এ যেন এক দিনের রোজার মাধ্যমে দুই বছরের পাপমোচনের আশীর্বাদ। কী অপার রহমত! কী গভীর দয়া প্রভুর! আর ঠিক পরের দিন—জিলহজ্জের ১০ তারিখ, পৃথিবীর সবচেয়ে মহৎ ঈদ—ঈদুল আযহা। কোরবানির মাধ্যমে ঈমানের সেই মহান পাঠ পুনরায় উচ্চারিত হয়, যে পাঠ দিয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)। তাদের সেই আত্মসমর্পণের ইতিহাস আজো কাঁপিয়ে তোলে মুমিন হৃদয়।

আল্লাহ বলেন: “আল্লাহর কাছে কোরবানির মাংস বা রক্ত পৌঁছায় না, পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ: আয়াত ৩৭)

কোরবানি মানে শুধু পশু জবাই নয়, বরং নিজের ভেতরের গাফিলতাকে জবাই করা, লোভ ও হিংসার গলায় ছুরি চালানো, নিজের স্বার্থপরতাকে ত্যাগের আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা। তাকওয়াই এই কোরবানির প্রাণ। আর এই জিলহজ্জেই তো সংঘটিত হয় হজ—ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। লক্ষ লক্ষ মানুষ পৃথিবীর চারদিক থেকে ভেঙে পড়ে কাবার দিকে, হৃদয়ে বহন করে “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক” ধ্বনি। এই পবিত্র তীর্থযাত্রা শুধু শারীরিক শ্রম নয়, এটি আত্মার জন্য একটি জন্মান্তরের মতো, যেখানে মানুষ ফিরে আসে পবিত্র হয়ে, মুক্ত হয়ে, নতুন জীবন নিয়ে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি হজ করল এবং অশ্লীল ও গোনাহ থেকে দূরে থাকল, সে যেন সেদিনই জন্মেছে।” (সহীহ বুখারী)

এই মাস আমাদের শেখায়—ত্যাগ মানেই হারানো নয়, বরং ত্যাগই হলো প্রকৃত প্রাপ্তি। জিলহজ্জ আমাদের ডাক দেয় আত্মার পরিচর্যায়, ঈমানের শানিত চর্চায়, হৃদয়ের অভ্যন্তরে গুনাহের কাঁটা উপড়ে ফেলতে। আসুন, এই মোবারক মাসে আমরা কেবল রীতিনীতি নয়, বরং মনের গহীন থেকে আল্লাহর প্রতি ফিরে যাই। যেন আমাদের প্রতিটি সকাল হয় কৃতজ্ঞতায় সিক্ত, প্রতিটি রাত হয় ক্ষমার কান্নায় বিহ্বল, প্রতিটি সজীব ইবাদত হয়ে উঠুক জান্নাতের পথে সিঁড়ি।

জিলহজ্জ শুধু সময়ের একটা নাম নয়—জিলহজ্জ এক ইবাদতের শিখর, এক ভালোবাসার উৎসার, এক ত্যাগের মহাকাব্য।
 

নোভা

×