
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই বৈপ্লবিক হলেও সামাজিক উন্নয়ন, সুরক্ষা ও অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে ধারাবাহিকতা বা গুণগত উত্তরণ এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। ১৯৭২ সালের প্রথম বাজেটের পর থেকেই দেখা যায়, রাষ্ট্রের মূল মনোযোগ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং খাদ্য, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো পুনর্বাসনের দিকে। প্রথম কয়েকটি বাজেটে সামাজিক খাতের উন্নয়ন নিয়ে স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা ছিল সীমিত। যদিও সংবিধানে সামাজিক ন্যায়বিচার, অসহায়দের সুরক্ষা, নারীর অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে, বাজেট বাস্তবতায় সেসব সংবিধানিক অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়নি। সত্তরের দশকের শেষে ও আশির দশকের শুরুর দিকে অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ায় বাজেট নীতিতে ধীরে ধীরে শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য খাত এবং কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রাথমিক রূপরেখা স্থান পেতে শুরু করে। তবে এসব বরাদ্দ ছিল নগণ্য এবং তা প্রধানত উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শেই আরোপিত হয়। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য-বিতরণ, কর্মসৃজন ও স্বল্প পরিসরে বয়স্ক ভাতা বা পল্লী রেশনিংয়ের মতো পদক্ষেপ ছিল সীমিত পরিসরে। রাষ্ট্র এখনো একটি ‘উন্নয়নমুখী’ ব্যয় কাঠামোকে গুরুত্ব দিচ্ছিল, যার মানে অবকাঠামো, কৃষি ও শিল্পে বরাদ্দকে প্রাধান্য দেওয়া।
নব্বই দশকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ফিরে আসার পর বাজেটে সামাজিক খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবারের মতো বয়স্ক ভাতা চালু করে, যা ছিল জনকল্যাণমূলক বাজেট চিন্তার সূচনা। এরপর বিভিন্ন মেয়াদে শিশু শিক্ষার উপবৃত্তি, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও মাতৃত্বকালীন ভাতা চালু হয়। তবে বাজেটে এই খাতগুলোর প্রকৃত প্রাধান্য বরাদ্দের হারে নয়, বরং রাজনৈতিক বক্তব্য বেশি ছিল। জাতীয় বাজেটের মোট আয় ও ব্যয়ের নিরিখে এই খাতগুলোতে ব্যয় এখনো সীমিত। উন্নত দেশগুলোর তুলনায় এই ব্যবধান সুস্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, নরওয়ে বা সুইডেন তাদের জিডিপির প্রায় ১৫-২০ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় করে। যেখানে বাংলাদেশে এই অনুপাত এখনো ৩ শতাংশের নিচে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১.১৪ ট্রিলিয়ন টাকা, যা মোট বাজেটের ১৬ শতাংশের মতো দেখালেও, এর অধিকাংশই পেনশন ও অনুরূপ পুরানো দায়বদ্ধতায় ব্যয় হয়। প্রকৃত অর্থে দরিদ্র বা প্রান্তিক জনগণের জন্য নতুন সামাজিক অন্তর্ভুক্তি প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল সীমিত এবং অপ্রতুল।
অন্যদিকে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দের প্রশ্নে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভাতা কর্মসূচি থাকলেও এর সুবিধা অল্পসংখ্যক মানুষ পান, যা মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মাত্র ২০ শতাংশের কম। ভাতার অঙ্কও অত্যন্ত নগণ্য। কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বাজেটে থাকে ব্যাপক কর্মসংস্থান সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, ভ্রমণ সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সেবা প্রাপ্তির সুযোগ। বাংলাদেশে এই ধরনের সমন্বিত বাজেট পরিকল্পনার অভাব এখনো প্রকট। নারী উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশ বাজেটে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ সুবিধা, শিক্ষা খাতে মেয়েদের উপবৃত্তি এবং নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় কিছু প্রকল্প চালু রয়েছে। তবে বাজেট প্রণয়নের সময় নারীর চাহিদা ও বৈষম্যবিষয়ক একটি সুসংহত জেন্ডার বাজেট বিশ্লেষণ হয় না। ২০০৯ সালে ‘জেন্ডার বাজেটিং’ নামে একটি ধারণা চালু করা হলেও এটি এখনো অনেকটা আনুষ্ঠানিক। প্রভাব মূল্যায়ন করে কার্যকর নীতিনির্ধারণে ব্যবহার হয় না। কানাডা বা সুইডেন বাজেটের প্রতিটি খাতে নারী-পুরুষের সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ নির্ধারণ করে থাকে। যেখানে বাংলাদেশে এই বিশ্লেষণ নেই বললেই চলে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেও সামাজিক উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ এখনো কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ করছে না। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের কম, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে অপ্রতুল। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারি ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। ফিনল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর বাজেটের বড় অংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। অথচ বাংলাদেশে সেই ধরনের প্রাধান্য স্থাপন হয়নি। স্বাস্থ্য খাতে একই ধরনের সংকট স্পষ্ট। করোনার সময় স্পষ্ট হয়েছে যে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা মূলত দীর্ঘদিন বাজেটে এই খাতে অবহেলার ফল। উন্নত দেশগুলো বাজেটে প্রতিনিয়ত জনগণের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। জার্মানি বা যুক্তরাজ্যের বাজেটে স্বাস্থ্য খাত পায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ। বাংলাদেশে এই খাতে বরাদ্দ হয় মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ। সেই বরাদ্দের অনেকটাই চলে যায় মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ব্যয়ে। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষত নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা উপকৃত হন না।
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের বাজেটে সামাজিক উন্নয়ন ও অন্তর্ভুক্তি একটি উপখাত হিসেবে এসেছে, মূলধারার ভাবনায় পরিণত হয়নি। বাজেট প্রণয়ন এখনো এলিটদের নিয়ন্ত্রণে, যেখানে দরিদ্র, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মতামত বা প্রয়োজন যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় না। জবাবদিহিহীনতা ও রাজনৈতিক লাভের হিসাবের কারণে অনেক সময়ই বাজেটের সামাজিক ব্যয়ের সিদ্ধান্ত হয় প্রচারধর্মী, টেকসই নয়। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে। ভুটান তার বাজেট প্রক্রিয়ায় ‘হ্যাপিনেস ইনডেক্স’ ব্যবহার করে, যেখানে নাগরিকদের মানসিক ও সামাজিক কল্যাণের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। ভারতেও ২০১৯ সালের বাজেট থেকে নারী ও শিশু কল্যাণে বিশেষ বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য পৃথক কোটা এবং শিক্ষাখাতে ডিজিটাল সুবিধা সংযোজন ইত্যাদির মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তির প্রয়াস চলমান। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বাজেট সামাজিক অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও, তার প্রতিফলন কাঠামোগত ও আর্থিকভাবে দৃঢ় হয়নি। সময় এসেছে একটি মানবিক বাজেট কাঠামো গড়ার, যেখানে নারী, প্রতিবন্ধী, প্রবীণ, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণ কেবল আলাদা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রতিটি বাজেট খাতে একটি অন্তর্নিহিত দর্শন হিসেবে স্থান পাবে। উন্নত বিশ্বের উদাহরণে দেখা যায়, যে সমাজ তার দুর্বলতম নাগরিকের দিকে তাকিয়ে বাজেট করে, সেই সমাজই শেষ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে উন্নত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ যদি সত্যিকারের মানবিক ও টেকসই উন্নয়ন চায়, তাহলে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এই গভীর অন্তর্ভুক্তির বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এটি কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, অর্থনৈতিক বিচক্ষণতার দাবিও।
যখন উন্নত দেশগুলোর বাজেট প্রণয়নের ইতিহাস ও বর্তমান প্রবণতা নিয়ে ভাবি, তখন স্পষ্ট হয় যে বাজেট কেবল অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দলিল নয়, এটি একটি জাতির সামাজিক অগ্রগতির মানচিত্র। সামাজিক উন্নয়ন, সুরক্ষা ও অন্তর্ভুক্তি। এ তিনটি উপাদান উন্নত দেশগুলোর বাজেটে দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রবীণ, শিশু ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বাজেটের আওতায় কীভাবে অর্থ বরাদ্দ ও ব্যবহার হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলে একটি জাতির মানবিক ও নৈতিক বিবর্তনের চিত্র স্পষ্ট হয়। ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো যেমন- সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ড অনেক আগেই বাজেটকে কেবল অবকাঠামো বা সামরিক ব্যয়ের বাহন না বানিয়ে বরং সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এই দেশগুলোতে বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, শিশু যত্ন, প্রবীণ সেবা এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ থাকে। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেন প্রতিবন্ধীদের জন্য বাসস্থান উন্নয়ন, কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ এবং ভ্রমণ ভাতা নিশ্চিত করেছে। এমনকি শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক সহায়তা নিশ্চিত করে আইনগত নিরাপত্তা দিয়েছে।
কানাডাও এই দিক দিয়ে অনেক দূর এগিয়েছে। সেখানে ২০১৮ সালে ‘জেন্ডার বাজেটিং অ্যাক্ট’ পাস করে বাজেটের প্রতিটি সিদ্ধান্তে লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এই বিশ্লেষণ পদ্ধতির নাম ‘জেন্ডারভিত্তিক বিশ্লেষণ প্লাস (এইঅ+)’ যা কেবল লিঙ্গ নয়, জাতি, বয়স, প্রতিবন্ধিতা, যৌন পরিচয়সহ নানামাত্রিক পরিচিতি বিবেচনায় নেয়। এর ফলে কানাডার বাজেটে নারী, আদিবাসী, অভিবাসী, এলজিবিটিকিউ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক বরাদ্দ নিশ্চিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল, সেটি বাজেট নীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, শিশু ও বেকার ভাতা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ডিসএবিলিটি লিভিং অ্যালাওয়েন্সসহ বহু সামাজিক সুবিধা বাজেট থেকেই আসে। স্বাস্থ্য খাতে যুক্তরাজ্যের বরাদ্দ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ১৭৬.২ বিলিয়ন পাউন্ড, যা সরকারি ব্যয়ের একটি বড় অংশ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভাতা ও সহায়তামূলক কর্মসূচিও দীর্ঘদিন ধরে চলমান। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ‘ইউরোপীয় সামাজিক তহবিল প্লাস’ নামক একটি বৃহৎ বাজেট তহবিল চালু করেছে, যার আওতায় ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ৮৮ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করা হবে দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জন্য। এই ফান্ড ইউরোপের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের জন্য একধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশের গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করছে। তবে উন্নত দেশ বলেই সামাজিক সুরক্ষা সবখানে একইরকম তা নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে যেমন সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে সীমিত। যদিও মেডিকেয়ার ও মেডিকেইড প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রবীণ ও দরিদ্র জনগণের জন্য কিছু স্বাস্থ্যসেবা আছে, তবু অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এসব সেবার বাইরে থেকে যায়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ‘সোশ্যাল সিকিউরিটি ডিসএবিলিটি ইনস্যুরেন্স’ ও ‘সাপ্লিমেন্টাল সিকিউরিটি ইনকাম’ প্রোগ্রাম চালু আছে, কিন্তু প্রাপ্তিযোগ্যতা কঠিন ও প্রক্রিয়া দীর্ঘ। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও ধীরে ধীরে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বাজেটে অগ্রাধিকার তৈরি হচ্ছে। চিলিতে ২০১৮ সালে একটি আইন পাস করে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্তত ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কর্মীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে কর্মসংস্থান কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে শিক্ষা ও সম্পূর্ণ অন্তর্ভুক্তির জন্য দেশটি এখনো সংগ্রাম করছে। ইউরোপের আরেক দেশ আয়ারল্যান্ডে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান হার মাত্র ৪১ শতাংশ, যেখানে জাতীয় গড় তার চেয়ে অনেক বেশি। সমস্যা হচ্ছে কর্মসংস্থান পেলে সরকারি ভাতাগুলো হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকির কারণে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি চাকরি করতে চান না বলে অভিযোগ আছে। এতে সামাজিক অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়াটি জটিল হয়ে পড়ে। এদিকে বাংলাদেশেও গত এক দশকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি কিছুটা সম্প্রসারিত হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে মোট বাজেটের ২.৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। যদিও এই খাতে বেশকিছু সফলতা এসেছে, তবে বরাদ্দের পরিমাণ, টার্গেটিং এবং বাস্তবায়নে এখনো বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। অনেকাংশেই বাজেট প্রণয়নের সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদা বা সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনায় আনা হয় না। একটি বড় সমস্যা হলো, বাজেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পুরানো ভাতাভোগীদের ওপর ব্যয় হয়, নতুন ও প্রকৃত প্রয়োজনে পৌঁছাতে পারে না। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা এখনো অনেক দেশে যথাযথভাবে হয় না।
২০২৩ সালে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে অনেক দেশই তাদের জিডিপির মাত্র ০.৫ শতাংশ বা তারও কম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তিতে ব্যয় করে। উন্নত দেশগুলো কিছুটা বেশি বরাদ্দ দিলেও চাহিদার তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। একইভাবে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্য কমানোর চেষ্টা হয়েছে অনেক দেশে। কানাডা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ নারী কর্মসংস্থান, মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশু যত্ন কেন্দ্র, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণ ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করছে। এসব কার্যক্রম সফল হলে নারীর আর্থিক সক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থান একসঙ্গে উন্নত হয়। ভবিষ্যতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই অভিজ্ঞতাগুলো গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হয়ে উঠতে পারে। বাজেট যখন কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি নিয়ন্ত্রণ করে না বরং সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা ও মানবিকতার দিকগুলোকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়, তখন তা একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নয়নের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। বাংলাদেশসহ মধ্যম আয়ের অন্য দেশগুলোর জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাজেট প্রণয়নে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাস্তব চাহিদা ও তাদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনা। সামাজিক উন্নয়ন, সুরক্ষা ও অন্তর্ভুক্তিকে বাজেটের মূল নীতির মূল স্তম্ভে পরিণত করতে না পারলে কেবল অবকাঠামো বা প্রবৃদ্ধির গৎবাঁধা গল্প দিয়ে জাতীয় উন্নয়নের সত্যিকার চিত্র আঁকা যাবে না।
আগামী বছরগুলোর বাজেটে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই দরকার একটি অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রক্রিয়া, যেখানে নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চাহিদা সরাসরি বাজেট আলোচনায় প্রতিফলিত হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে জেন্ডার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বিশ্লেষণ করে বাজেট প্রস্তাব দিতে হবে, শুধু নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপর এই দায়িত্ব চাপিয়ে না দিয়ে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা ও পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি তা ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার মাধ্যমে সঠিক উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের মতো খাতে অন্তর্ভুক্তিকরণকে মূলধারায় আনতে হবে, যাতে সমাজের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রীয় সেবায় সমানভাবে অংশ নিতে পারে। সবশেষে, এ নীতিগুলোর বাস্তবায়ন পর্যালোচনায় স্বাধীন ও জবাবদিহিমূলক একটি কাঠামো নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত অন্তর্ভুক্তির ভিত্তি।
মে ২৬, ২০২৫
[email protected]
প্যানেল