ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ভুল তথ্যের টালমাটাল

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:২৩, ২৭ মে ২০২৫

ভুল তথ্যের টালমাটাল

বেশ ক’বছর আগের কথা। ধানমন্ডি মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে সারাদিনের কনসার্ট চলছে। একের পর এক গান গাইছেন ‘হাজার দর্শক মন মাতাইয়া....’র শিল্পী মিলা এবং তার মতো অন্য শিল্পীরা। অনুষ্ঠানের গ্ল্যামার বাড়াতে সেসময়ের প্রথম সারির মডেল-অভিনেত্রীরা তো ছিলেনই, নব্বই দশকের শীর্ষ মডেল-অভিনেত্রীসহ শো-বিজের সিনিয়র-জুনিয়র অনেক শিল্পীই ছিলেন। সবাই নারী।
ওটা ছিল নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কনসার্ট। ওখানে শ্রমিক নারী নিষেধ। যদিও সে কথা কোথাও উল্লেখ নেই। তাদের জীবনের খেরোখাতায়ই এসব অনুষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার বিধান নেই। সেই আঠারোশ’ সাতান্ন সালে শ্রমের দাসত্বের বিরুদ্ধে যদিও তারাই রাস্তায় নেমেছিলেন এবং অর্জন করেছিলেন আট মার্চ। এ কথা নিশ্চয়ই জানা আছে, কনসার্টের ‘আত্মবিশ্বাসী’ শিল্পী-শ্রোতাদের। তবে সেটা হয়তো তথ্য জানার খাতিরেই। তার বাইরে এর অন্য কোনো তাৎপর্য নেই এবং ওই তথ্যই আত্মবিশ্বাসের অর্থের হাতবদল করে দিয়েছে। তথ্যের ফেরিওয়ালা এখন বহুজাতিক কোম্পানি। আত্মবিশ্বাসের সূত্র লাক্স কিংবা পন্ডস, সান সিল্ক কিংবা ক্লিয়ারের রেসিপিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এর শক্তি ও সম্মোহন চেতনার চারপাশে যে বলয় তৈরি করে তা ভাঙা কঠিন। আঠারো শতকে মেরী ওলস্টোন ক্রাফট বলেছিলেন, ‘নারীর অধিকার স্বীকৃত হলেও তা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করা কঠিন। নারীর প্রতি প্রত্যক্ষ অপমান ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ, কিন্তু নানাবিধ বিশ্লেষণে গালভরা প্রশংসা করে তাকে যে অন্তপুরে রুদ্ধ করে রাখা হয় তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা খুবই কঠিন।’ মেরী বিকশিত হয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লবের আবহে। সত্যটা তাই সহজ করে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। গালভরা প্রশংসার বর্ণাঢ্য আয়োজনে নানাবিধ নামের কোম্পানি নারীকে যে কপট স্বাধীন আকাশে ভাসাচ্ছে সেখানে আছে কেবল সৌন্দর্য আর বাণিজ্য। গ্রাম-মফস্বল থেকে ছেঁকে আনা সুশ্রী কিশোরীকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঝেড়ে মুছে গ্রুমিং করিয়ে পাঁচতারা হোটেলের আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে চূড়ান্ত সাফল্যের বিজয় মুকুট পরিয়ে দিলে আলোর ঝলকানিতে তার তো মাথা খারাপ হবেই। তিন বেলা পেটপুরে খাওয়াই ছিল যার স্বপ্ন, ব্র্যান্ডনিউ গাড়ির চাবি হাতে পেয়ে সে তো স্বপ্নরাজ্যে ফানুসের জাল বুনবেই। এই স্টার-সুপারস্টারই হন নারী দিবসের কনসার্ট বা ওই জাতীয় অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। হতেই হবে কারণ সুপারস্টার যারা বানান, অনুষ্ঠানগুলো তারাই স্পন্সর করেন। তাদের লক্ষ্য পরিষ্কার- নারী বিশেষত কিশোরীদের কানে ‘স্বাধীনতার’ তথ্য পৌঁছে দেওয়া। তথ্য পৌঁছানোর জনপ্রিয় মাধ্যমগুলোর নেপথ্য নিয়ন্ত্রকও তারা। সুতরাং প্রশংসার গালভরা বিশেষণ তৈরিতে কোনো অসুবিধা হয় না। একেবারে ‘হীরক রাজার দেশে’র পাগলা বিজ্ঞানীর সেই মস্তিষ্ক প্রক্ষালক বা মগজ ধোলাইয়ের মতো বিষয়। একবার ধোলাই হলেই ব্যস! চেতনা নাশ। এ রকমই এক কোম্পানির এ দেশীয় হর্তাকর্তা এক সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় বলেছিলেন, ‘তরুণীদের বেশি করে পুরুষদের সামনে আনতে হবে। যাতে তরুণ যুবকরা তাদের বেশি করে দেখার সুযোগ পায়। তাদের দেখতে দেখতে পুরুষদের চোখ সয়ে যাবে। তাহলে তারা আর ইভটিজিং বা নারী নির্যাতন করবে না।’
ইভটিজিং আর নির্যাতন প্রতিরোধে কি চমৎকার ফর্মুলা! পুরুষের ‘চোখ সওয়াতে’ তরুণীদের প্রদর্শনীর বস্তু করে আনতে হবে। তা তো তারা আনছেনই কিন্তু ইভটিজিং কমছে কই বরং এর ভয়াবহতা আর অভিনবত্ব দিন দিন বাড়ছে। তারা কি জানেন না নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরির পদ্ধতি এটা নয়? সন্দেহ হয়। তারা জানেন কিন্তু জানাতে চান না। এভাবে দেখলে পাওয়ার কামনা বাড়ে, ভালোবাসার বোধ তৈরি হয় না। যে কোনো সুস্থ সম্পর্কের পেছনে থাকে সম্মান-ভালোবাসা-বিশ্বাস; সম্মান করতে জানলে তবেই ভালোবাসা যায়। এর অভাবে বাড়ে বৈরিতা। ভুল তথ্যের টালমাটাল বাণিজ্যের আবর্তে পড়ে অনেক তরুণ-তরুণী খেই হারিয়ে ফেলছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মানবিক সম্পর্কের বোধের জায়গাটা যেন ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে।
বাজার ও বিজ্ঞাপনের ডামাডোলে কোনো কিছুই আর আলাদা করে চেনার উপায় নেই। জীবন জগতের সবই এখন বিক্রয়যোগ্য পণ্য। বাজার ও পণ্যনির্ভর সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান কোথায় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। নারী দিবস এখন বাবা দিবস, মা দিবস, পরিবার দিবসের মতো কনসার্ট, কার্র্ড, ওয়াল পেপারে মোড়ানো দিবস উদ্যাপনের প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। এর পেছনের দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস ভুলে থাকা কিংবা ভুলিয়ে দেওয়া অথবা বিকৃতভাবে উপস্থাপনের তোড়জোড়ে যেন সত্যিই ভুলে না যাই ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চের সুঁই কারখানার নারী শ্রমিকদের কথা। অর্জনটা তাদের। নারী দিবসের ইতিহাস শ্রমিক নারীর ইতিহাস। গালভরা প্রশংসার পঞ্চবাণ আর গ্ল্যামারের মায়াকাজল পরে পৃথিবী যতই রঙিন মনে হোক বাস্তবতা অতটা রঙিন নয়। মধ্যবিত্ত নারীর চলা সহজ হয়েছে, বলা ভালো সম্ভব হয়েছে তাদেরই জন্য। অফিসে দায়িত্বশীল পদে নারী যখন নির্বিঘ্নে কাজ করেন, সংসারের ভার থাকে তখন আরেক নারীর ওপর। তিনি গৃহশ্রমিক। তিনি না থাকলে অনিবার্যভাবে স্বাভাবিক কাজে ছন্দপতন হয়। কারণ বাইরের জগতের দায়িত্ব পালন করুন না করুন ঘরকন্নার আসল দায় নারীর। ঘরের শ্রম সামাজিক শ্রমের মর্যাদা পায়নি আজও।
আজকের দুনিয়া স্পষ্ট দুটি সীমারেখায় ভাগ হয়ে গেছে। তথ্যসমৃদ্ধ আর তথ্যবঞ্চিত। তথ্যবঞ্চিতদের মধ্যে নারীর স্থান সবার আগে। তার চেয়েও বেশি ভুল তথ্য পাচ্ছেন তারা। যে কিশোরীর বিশ্বাস সুপারস্টার হওয়ার মধ্যেই জীবনের স্বার্থকতা সে যত যত্নে সানসিল্ক বা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি মাখবে তত আগ্রহে হাতে তুলে নেবে না বিশ্বসাহিত্যের একখানা বই। যত অনায়াসে সে রং ফর্সাকারী ক্রীম উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে পারবে ততটা স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে বলতে পারবে না বিজ্ঞান কিংবা দর্শনের উল্লেখযোগ্য কোনো থিয়োরির নাম। রূপ শানানো যত জরুরি তার কাছে, বুদ্ধি শানানো ততটাই গুরুত্বহীন। তার বিশ্বাসের ভিতটা এভাবেই গড়ে উঠেছে। তথ্য তার কাছে সেভাবেই পৌঁছেছে। সঠিক তথ্য সঠিকভাবে পৌঁছানো তাই জরুরি।
গত শতকের সত্তর দশকের শুরুতে ‘দারিদ্র্যবিমোচন’ ‘গ্রামোন্নয়নের’ ঢেউ উঠেছিল। গ্রাম উন্নয়নের নানা কর্মসূচি, দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ইত্যাদি কাজের জন্য তখন ‘দুর্বার বেগে’ এ সব সংস্থা কাজ করেছে। তাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূর না হলেও সংস্থার কর্ণধারদের জীবনে আর্থিক পরিবর্তন শুধু চোখে পড়ার মতো নয়, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার স্তরে পৌঁছেছিল। দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচির পর মনোযোগের কেন্দ্রে আসে নারী উন্নয়ন কর্মসূচি। যথারীতি সেখানেও উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়। সে সময় অনুন্নত দেশগুলোতে ‘দারিদ্র্য ও বেকারত্ব সৃষ্টি রোধ’ করার জন্য এক ‘নতুন উন্নয়ন কৌশল’-এর ফর্মুলা প্রেসক্রাইব এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তহবিল সরবরাহ করা  হয়। বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নামে পরিচিত এ সব সংস্থার কাজ মূলত গ্রামমুখী হওয়ায় শহরের বিত্তবান নারীরা এর মধ্য দিয়ে ‘সমাজ সেবায়’ খুব বেশি ‘অবদান’ রাখতে পারলেন না। এ সুযোগ এলো মূলত আশির দশকে। ‘নারীমুক্তি’ বিষয়টি যখন শহুরে সমাজে বার্নিং ইস্যু। ‘নারীর জীবন মান বাড়াতে’ নানা নামে ও বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ করছে অসংখ্য বেসরকারি সংস্থা। সমাজসেবায় নিজেকে নিবেদিত করার সুবর্ণ দরজা খুলে গেল। ননপ্রফিট সমাজসেবা আশ্চর্য এক জাদুমন্ত্রে স্রোতের মতো প্রফিট বয়ে আনতে শুরু করল। নারী বিষয়ক সংস্থার পাশাপাশি তথাকথিত উন্নয়নমূলক দারিদ্র্যবিমোচনকারী অনেক সংস্থার লক্ষ্যও শুরু থেকে হয় নারীর ‘সার্বিক না হোক অর্থনৈতিক মুক্তি’ ঘটিয়ে তার জীবনের মান বাড়ানো। তাকে স্বাবলম্বী করা। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে দেশজুড়ে  দারিদ্র্যবিমোচন ও নারীর স্বাবলম্বনের নেট রেজাল্ট কি? দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে এসব সংস্থার ভূমিকা কতখানি? প্রান্তিক নারীরা কী হারে মুক্ত হয়েছেন? এ সব প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর পাওয়া যায় না।

প্যানেল

×